বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চোর

আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:১২
 

পড়ন্ত দুপুরে নিনার কল দেখে আমি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলাম। আমার মনে হলো এই কলটা রিসিভ করলেই নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাব। নিনা হয়তো হাসপাতাল থেকে গলা ফাটিয়ে বলবে—‘আমার বাবা মারা গেছে।’ আমি নিনার বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনতে চাই না। তবুও ভীরু আঙ্গুল দিয়ে ফোন রিসিভ করেই কান পেতে রইলাম ওপারে। না, নিনা কোনো খারাপ খবর শোনায়নি। ওর বাবা আগের থেকে বরং সুস্থ। হার্টের যে প্রবলেম ছিল, সেটা মোটামুটি শঙ্কামুক্ত। তবে যেটা আসল সমস্যা, সেটা হলো নিনা তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাচ্ছে না পাঁচ হাজার টাকার অভাবে। নিনার হাতে কোনো টাকা নেই। সব টাকা তার বাবার চিকিত্সার পেছনে শেষ। উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিনা আমার কাছে কল করেছে টাকা পাবার আশায়।

আমি বেকার মানুষ। পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে লাখ টাকার মতো। তবু আমি নিনাকে নিরাশ না করে বললাম—‘ঠিক আছে আমি এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা নিয়ে হাসপাতালে আসছি।’

কিন্তু টাকা পাব কোথায়? পকেটে শ’খানেকের মতো টাকা আছে। হঠাত্ মনে পড়ল বড়দার কথা। বড়দা তার অফিসের বেতন পেয়েছে গতকাল। পুরো দশ হাজার টাকা। তার রুমের টেবিলের ড্রয়ারে ভরে রাখতে দেখেছি আমি। সেখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা সরিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো নিনার বাবাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ  দেবে না।

না। আমি আর দেরি করলাম না। বড়দা এখন বাসায় নেই। ছাদে গেছে, নয়তো পুকুরঘাটে বসে ফেসবুকিং করছে। যা করার এখনই করতে হবে। হ্যাঁ এখনই। চুপিচুপি ড্রয়ার খুলে পুরো পাঁচ হাজার টাকা পকেটে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। তারপর সোজা হাসপাতালে।

২.

টাকাগুলি পেয়ে নিনা আনন্দে কেঁদে দিল। কাঁপা গলায় বলল—‘আমি তোকে মিথ্যে বলেছি। রিলিজের জন্যে এই টাকা নয় রে। আজ আবার ডাক্তারবাবু বলেছেন বাবার চোখেরও নাকি অপারেশন করাতে হবে। সাত হাজার লাগবে। আমার কাছে আছে মাত্র দুই হাজার।’ নিনা আমার সামনে নত হয়ে আছে মিথ্যে বলার অপরাধে। তাকে সাহস দিয়ে বললাম—‘তুই সত্যটা বললেও আমি তোর জন্য টাকা নিয়ে আসতাম।’

নিনা মরা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পানি।

আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মেয়ে নিনা আমার ক্লাসমেট। কলেজে ওর সঙ্গে আমার দারুণ সখ্য ছিল। আমি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছি। নিনা এখনো পড়ালেখা নিয়ে আছে। এ মাসে ওর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা।

৩.

বাসায় এসে দেখি মুন্নী কাঁদছে। মুন্নী আমাদের বাসায় কাজ করে। খুব ভালো মেয়ে। এই প্রথম মুন্নীকে কাঁদতে দেখলাম। ‘ছোটদা, শুনছ, বড়দা বলছে আমি নাকি উনার পাঁচ হাজার টাকা চুরি করেছি!’—মুন্নীর কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম!

বড়দার ঘরে এসে দেখি বড়দা মন খারাপ করে চেয়ারে বসে আছে, আর কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রী ভাষায় মুন্নীকে গালি দিচ্ছে। আমি আস্তে করে বললাম—‘বড়দা।’ আমাকে পাত্তা না দিয়ে বড়দা বলল—‘এখান থেকে যা তো! আমার মাথা গরম। টাকা বের না করলে ঐ হারামজাদিকে আজ বিদায় করব।’ বড়দার উচ্চকণ্ঠের এই কথাটা পাশের ঘর থেকে শুনে মুন্নী কান্নার শব্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে বলল—‘দোহাই বড়দা, আমাকে বিদায় করবেন না। আমার বাবা-মা নেই। কোথায় যাব?’

রান্নাঘর থেকে মা ছুটে এসে মুন্নীর চুল টেনে ধরে বলল—‘আমার ছেলের টাকা বের কর বলছি। আমার ছেলের রুজি করা হালাল টাকা।’ মুন্নী পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে কাঁদছে—‘খালাম্মা, আমি টাকা চুরি করি নাই। আল্লাহর কসম। আমার মরা বাপ-মার কসম।’ মুন্নীকে নির্যাতনে যোগ দিতে বড়দাও যখন তেড়ে আসছে, তখনই বাধা দিলাম আমি। বীরের মতো বললাম—‘মা, বড়দা, তোমরা কী শুরু করেছ মুন্নীকে নিয়ে! ও সত্যি চুরি করেনি। আমি টাকা চুরি করেছি।’

আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অবাক করা কথাটি বলেছি, এমন ভঙ্গিমায় মা আর বড়দা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুন্নী দৌড়ে এসে আমার পায়ের ওপর পড়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। বড়দা বলল—‘তুই সত্যি বলছিস?’ বুকে সাহস নিয়ে বললাম—‘সত্যি বলছি। আমার ক্লাসমেট নিনার বাবার চিকিত্সার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা দরকার পড়েছে। নিনা আমার কাছে টাকা চেয়েছে। আমি তোমার ড্রয়ার থেকে চুরি করে পাঁচ হাজার...!’ কথা শেষ না হতেই মা উল্কার মতো ছুটে এসে আমার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে উচ্চস্বরে বলল—‘তুই চোর? আমি চোর পেটে ধরেছি?’

বড়দা আমার শার্টের কলার ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতর থেকে বলল—‘তোর মতো চোর ভাই আমার দরকার নাই।’ মুন্নী আবারো উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিল। নির্দোষ মেয়েটা আজ কত না নাজেহাল হলো। গরিব হয়ে জন্মালে বুঝি এমনই হয়!

আমি দাঁড়িয়ে আছি আমাদের প্রকাণ্ড উঠোনে। ঘরের দরজা বন্ধ। টাকা চুরির অপরাধে বড়দা আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তার সেই অধিকার আছে। কারণ বাবার অবর্তমানে সে-ই এখন এই সংসারের কর্তা। আমি টাকা চুরি করেছি জেনে মাও রাগে ক্ষোভে আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারও সেই অধিকার আছে। কারণ আমি চোর। চুরি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। যদিও বাইরের লোকের কিছু চুরি করিনি, তবে বড়দার টাকাটা চুরি করাটাও অবশ্যই অন্যায় কাজ। অন্যায়, কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। বিবেকদংশন হচ্ছে না। আমার অসহায় গরিব বন্ধু নিনার বড় বিপদে তার পাশে তো দাঁড়াতে পারলাম। মুন্নীকেও তো চোর অপবাদ থেকে রক্ষা করা গেল! নিজে চোর হওয়ার বিনিময়ে এসব অর্জন খারাপ না।

[আমিশাপাড়া, নোয়াখালী]

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন