গত ১৪ মে তুরস্কে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তীক্ষ দৃষ্টি ছিল সারা বিশ্বের। বহু দিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এই নির্বাচন। নির্বাচন শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো এর উত্তাপ কমেনি এতটুক! এর কারণ, নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারোগলুর লড়াই দেশটির কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ‘হাড্ডাহাড্ডি’ হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রার্থীই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় নির্বাচন গড়িয়েছে দ্বিতীয় দফায় (রানঅফ)। তুরস্কের সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিল (ওয়াইএসকে) বা প্রধান নির্বাচন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, কোনো প্রার্থীই ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম। এই হিসাবে আগামী ২৮ মে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণের কথা রয়েছে।
তুরস্কের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, ‘তুরস্কের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্ববহ।’ কেউ কেউ এমনকি এ-ও জোর দিয়ে বলেছেন, ‘শুধু তুরস্ক নয়, সারা বিশ্বের জন্যই ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন। কেননা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের ইলেকশনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।’
রোববারের (১৪ মে) ভোটে তুরস্কের লাখ লাখ নাগরিক তাদের প্রেসিডেন্টকে বেছে নিতে ভোটে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ দুই দশক ধরে ক্ষমতার মসনদে থাকা বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আবারও প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসবেন, নাকি নতুন কাউকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেবে তুরস্কের জনগণ—এই প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এখনো দিন দশেক।
নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ৬০০ আসনের সাংসদ বেছে নিতেও ভোট দেন তুর্কিরা, যেখানে বিজয় লাভ করেছে এরদোয়ানের দল। নির্বাচনে অংশ নেয় ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও পাঁচটি রাজনৈতিক জোট (দ্য পিপলস অ্যালায়েন্স, দ্য নেশন অ্যালায়েন্স, দ্য এটিএ জোট, শ্রম ও স্বাধীনতা জোট ও ইউনিয়ন অব সোশ্যালিস্ট ফোর্সেস অ্যালায়েন্স)। প্রথম দিকে নির্বাচনের মাঠে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ছিলেন চারজন—বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, কেমাল কিলিচদারোগলু, সিনান ওন ও মুহরেম ইনস। ইনস নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন বাকি তিন জন। যদিও মূল লড়াইটা হয়েছে এরদোয়ান ও কিলিচদারোগলুর মধ্যে, যা অনুমেয় ছিল আগেই।
তুরস্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা তুরস্কের ইতিহাসে অন্যতম ‘সর্বোচ্চ টার্নআউট’। ওয়াইএসকের অনানুষ্ঠানিক ফলাফল অনুসারে, এরদোয়ানের দ্য পিপলস অ্যালায়েন্স পার্টি পেয়েছে মোট ভোটের প্রায় ৫০ শতাংশ (৪৯ দশমিক ৫১ শতাংশ)। এরদোয়ানের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিলিচদারোগলুর জোটও বেশ ভালো করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো প্রার্থীই এককভাবে নির্ধারিত ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় ফলাফল শেষ পর্যন্ত ‘রানঅফে’ ঝুলে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৮ মে দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে, কে হতে চলেছেন তুরস্কের শাসনকর্তা—ফলাফলের শীর্ষে থাকা প্রার্থী এরদোয়ান, নাকি চমক জাগানো কিলিচদারোগলু?
বরাবরের মতো এবারের নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়—এ কথা বলতেই হবে। এরদোয়ান যেমনটি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘নির্বাচন উৎসব আমেজে পরিণত হয়েছিল।’ সত্যি বলতে, নির্বাচনের সময় উল্লেখযোগ্য কোনো ‘সমস্যা’ লক্ষ করা যায়নি। তুরস্কের নাগরিকেরা ব্যালট বাক্সে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন বেশ স্বচ্ছন্দে। তুরস্কের গণতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ এই সংস্কৃতি। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের সফল আয়োজন তুরস্কের জন্য গর্বের বিষয়ও বটে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তুরস্ক যে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের উৎসবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবিক অর্থেই তা পরিপক্ব গণতন্ত্রের ভালো উদাহরণ। যদিও এ নিয়ে ভিন্ন কথাও প্রচলিত আছে বাজারে! বিভিন্ন পক্ষ দাবি করে আসছে, তুরস্কে এমন এক কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে, যেখানে মূলত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শক্তিশালী রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র জানতে পারাটা কঠিন! সত্যিই কি তাই? সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো দেখেও তুরস্কের গণতন্ত্রকে ‘পরিপক্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করাকে ‘অবান্তর’ বলা কি সমীচীন? অনেক প্রতিষ্ঠান তুরস্কের গণতন্ত্রকে যেভাবে ‘মহান’ হিসেবে উল্লেখ করছে, তা কি সত্য নয়?
প্রথমত, এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ, যা রেকর্ড। এটা কি কোনো ‘আহামরি বিষয়’ নয়? তুর্কি জনগণের সচেতনতা এবং তুর্কি গণতন্ত্রের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এই একটি বিষয়ই তো যথেষ্ট, তাই না? তুর্কিরা খুব ভালোভাবে জানে যে, প্রকৃত রাষ্ট্রীয় শক্তির মালিক ‘জনগণ’ তথা সরকার পরিবর্তন করা-না করা তাদের মর্জিতে চলবে। আজকের দিনে এই সংস্কৃতিকে কি ব্যাপক মূল্যায়ন করা উচিত নয়? বস্তুত, তুরস্কে ‘গণতন্ত্র’ যে শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, গণতন্ত্রের প্রতি তুর্কি জনগণের আস্থা ও সন্মান প্রদর্শন থেকে সেই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমি সর্বদা জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। পরবর্তী নির্বাচনেও এই সম্মান ধরে রাখব।’ এরদোয়ান ও তার দল বারবার বলছে, বিরোধীরা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হবে না। স্মরণে থাকার কথা, এরদোয়ান ও তার দ্বারা নিযুক্ত ক্ষমতাসীন বিচারপতি এবং ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি দেয়। এই উদাহরণ টানার কারণ, ঐ নির্বাচনে বেশির ভাগ মহানগরীতে ভালো ফল করেছিল বিরোধী শিবির।
তৃতীয়ত, এবারের নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়েছে, গভীর আর্থিক সংকট ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ভূমিকম্প-বিপর্যয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরদোয়ান ও তার দল ফলাফলের শীর্ষে অবস্থান করছে। এর সহজ অর্থ হলো, তুরস্কের জনগণ এখনো এরদোয়ানকে তাদের যোগ্য নেতা হিসেবে মানে এবং দেশ তার হাতে নিরাপদ বলেই মনে করে।
চতুর্থত, আপামর তুর্কি সমাজ কোনো ধরনের উদ্বেগ ছাড়াই অতি সহজে, স্বচ্ছন্দে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এটা ভালো ও উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। উদাহরণস্বরূপ, একে পার্টি ও রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) মতো মূলধারার রাজনৈতিক দল ছাড়াও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি) কিংবা গ্রিন লেফট পার্টির (ওয়াইএসপি) মতো আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে, যা গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ঊর্ধ্বে মেলে ধরে। এমনকি অনেক গোষ্ঠী নিজেদের পরিচয় গোপন না করেই (এমন কিছু গোষ্ঠী আছে তুরস্কে, নির্বাচনে প্রকাশ্যে এলে তারা বিপত্তিতে পড়তে পারে বলে মনে করা হয়) ভোট দিয়েছে প্রকাশ্যে, যা গণতন্ত্রের সুস্থতার অন্যতম নিয়ামক।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মিডিয়া ও রাজনৈতিক পক্ষ যা-ই বলুক না কেন, তাদের দেখানো পথে কখনোই হাঁটবে না তুরস্কের জনগণ। তাদের বাতলে দেওয়া পথে না গিয়ে বরং যোগ্য নেতা খুঁজে নিতে তুর্কি জনগণ নিজেদের আস্থার ওপরেই ভরসা রাখবে। সেরা প্রার্থী বেছে নিতে তুর্কিরা যথেষ্ট পরিপক্ব এবং তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ধরনের ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ গ্রহণ করবে না তারা। এভাবেই বিভিন্ন পক্ষের নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও, তুরস্কের জনগণ ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য’ উপভোগ করে যাবে যুগের পর যুগ। এ কথা আজকের দিনে আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, তুর্কি জনগণ ও তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া বিকল্প রাস্তা খোলা নেই সমালোচকদের সামনে। তুরস্কের গণতন্ত্র যে কোনো সময়ের চেয়ে আজ অনেক বেশি পরিপক্ব—এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ কম।
লেখক : তুরস্কভিত্তিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এসইটিএ ফাউন্ডেশন’-এর ফরেন পলিসি স্টাডিজের পরিচালক; আংকারা ইউনিভার্সিটির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও ‘ইনসাইট তুরস্ক’-এর প্রধান সম্পাদক
তুরস্কের ‘ডেইলি সাবাহ’ থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন