সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে’

আপডেট : ১৮ মে ২০২৩, ০০:২০

বিপাকে পড়া কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কী—তাহা বর্তমানে সবচাইতে ভালো বুঝিতেছেন বিভিন্ন কলকারখানার মালিকেরা। এই মুহূর্তে এই সংক্রান্ত উদাহরণের অভাব নাই। গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি সংবাদের দিকে মোটা দাগে দৃষ্টি দেওয়া যায়। খবরে বলা হইয়াছে—চাউল উৎপাদনের ভরা মৌসুমে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়িয়াছেন দিনাজপুরের চালকল-মালিকরা। ধান সংগ্রহ করিয়াও বিদ্যুতের অভাবে অধিকাংশ সময় মিল বন্ধ রাখিয়া বসিয়া আছেন তাহারা। সরেজমিনে কিছু অটোরাইস মিলে গিয়া সংবাদটির প্রতিবেদক দেখিয়াছেন যে, মিল ও মিল চত্বরে কয়েক হাজার ধানের বস্তার উপর মিলের শ্রমিকরা শুইয়া-বসিয়া সময় কাটাইতেছেন। আগে তাহারা বসিয়া থাকিতেন ধানের অপেক্ষায়। এখন মিল ধানে ভর্তি, কিন্তু তাহারা বসিয়া আছেন বিদ্যুতের অপেক্ষায়। অবস্থা এমন যে, মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ আসিলেও মিলের সুইচ দিতেই তাহা নাই! একজন মিল মালিক বলিয়াছেন, একটি ড্রায়ার চালাইতে প্রতিবার ধান লাগে ৩০০ বস্তা (প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি), সকল কিছু ঠিকঠাক থাকিলে দিনে দুইটি ড্রায়ারে চাউল উৎপাদন করা যায়, কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরিয়া বিদ্যুতের যেই অবস্থা তাহাতে দুই দিনেও একটি ড্রায়ার করা যাইতেছে না। বস্তুত, অটোরাইস মিলের একটি ড্রায়ার চালু করিবার জন্য প্রথমেই ছয় ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ চলিয়া যাইতেছে আধঘণ্টা পরপর। ফলে ড্রায়ারের চাউল অধিকাংশই ভাঙিয়া যাইতেছে। 

ইহা তো অটোরাইস মিলের চিত্র। সারা দেশে নানান ধরনের অসংখ্য শিল্প-কলকারখানা রহিয়াছে। তাহাদের দশা কীরূপ হইতে পারে? অটোরাইস মিলের চিত্রটি হইল চুলায় চড়ানো চাউলের হাঁড়ির মতো—যাহার ভিতরকার একটি ভাত টিপ দিয়া বোঝা যায় পুরা হাঁড়ির ভাতের কী অবস্থা! বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অনেক অর্জনের কথা বলা হয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কথা আমরা শুনিতে পাই। কিন্তু ইহা যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো! সত্যিকার অর্থে, বিদ্যুতের অব্যবস্থাপনা, অসম্পূর্ণ কারিগরি সক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হইয়া উঠিয়াছে। সারা দেশের বহু অঞ্চলে সারা দিনে ১০ হইতে ১২ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করে। সাধারণ বাসাবাড়ি কিংবা সড়কের বিদ্যুতের বাতির ক্ষেত্রে বিদ্যুতের এই আসা-যাওয়ার সমস্যা হয়তো অতখানি ভয়ংকর নহে। কিন্তু ঘনঘন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করিলে শিল্পকারখানাগুলির মেশিনারিজের কী অবস্থা হইতে পারে—তাহা কেবল শিল্পকারখানাগুলির মালিকরাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারেন। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার যেমন বলিয়াছেন—‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে—।’ সুতরাং বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়ার যাতনা কলকারখানার মালিকদের মতো করিয়া আর কেহ বুঝিতে পারিবেন না। আধুনিক কলকারখানার মেশিনারিজ এমনিতেই সূক্ষ্ম ও উচ্চপ্রযুক্তির হইয়া থাকে। ইহাদের নিয়ম মানিয়া স্টার্ট ও শাটডাউন করিতে হয়, নচেৎ হঠাৎ পাওয়ার অফ হইয়া মেশিন বন্ধ হইলে উহার সূক্ষ্ম প্রযুক্তিতে ধাক্কা লাগে এবং এই ধাক্কা বারংবার লাগিলে অনেক ক্ষেত্রেই মেশিন বিগড়াইয়া যায়। সুতরাং আধুনিক কলকারখানা চালাইতে গেলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহার ব্যত্যয় ঘটিলে মেশিনারিজ বারংবার বন্ধ হইয়া উৎপাদন ব্যাহত করে, মেশিন নষ্ট হইয়া খরচ বৃদ্ধি করে। উৎপাদন কম হইলে প্রডাকশন খরচ বৃদ্ধি পায়, প্রডাকশন খরচ বৃদ্ধি পাইলে লভ্যাংশ কমিয়া যায়, যাহার প্রভাব পড়ে কারখানার জনশক্তি হইতে শুরু করিয়া রাজস্ব পর্যন্ত। এমনিতেই সারা বিশ্বে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং জাহাজ পরিবহনের মাশুল কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে, টাকার মূল্যহ্রাস ঘটিতেছে প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় প্রায়োরিটি দিয়া বুঝিতে হইবে কোথায় বিদ্যুৎ অপরিহার্য! 

একটি দেশের শিল্প-কলকারখানাগুলি হইল মধুর চাকের মতো। কিন্তু মধু পাইতে হইলে উহার উপযুক্ত পরিবেশ চাই। মৌমাছির পেট অধিক চাপাচাপি করিলেই তো আর মধু হইবে না। বরং বেশি চাপাচাপি করিলে মৌমাছিটাই মরিয়া যাইতে পারে। সুতরাং যখন যেই সময় যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হইতেছে—তখন সেই সময়ের পরিস্থিতি অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সঠিক পরিকল্পনায় ব্যবহার করিতে হইবে।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন