একটি উন্নয়নশীল দেশের নির্বাচিত তথা বেসরকারি সরকারের সমস্যা বহুবিধ। এই সকল দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হইল, তাহারা মনে করেন প্রশাসন তাহাদের, ব্যবসায়-বাণিজ্য তাহাদের, এমনকি দেশের সম্পদও তাহাদের। ইহার উপর কেবল তাহাদের অধিকার আছে, আর কাহারও নাই। এই জন্য দেখা যায়, তাহারা অযৌক্তিকভাবে সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন। ইহার মাধ্যমে তাহারা নিজের দলের নেতাকর্মীদের সুবিধা পাওয়াইয়া দেন। আর এইভাবে তাহারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হইয়া যান। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সংকটের গোড়ায় গলদ এইখানেই। এই জন্য দেখা যায়, যাহারা ক্ষমতায় যাইতে পারে নাই, তাহাদের পক্ষে সেই সরকারকে যে কোনোভাবে টানিয়া নামানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। এই সকল দেশে প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিও ঠিকমতো গড়িয়া উঠে নাই। তাহা ছাড়া এই সকল দেশের সরকার এমনভাবে পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনকে সাজাইয়া তুলে, যেইখানে সরকারি দলের লোক ছাড়া অন্যের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ পাওয়ার আশা করা বৃথা। সেইখানে সাধারণ নিয়মকানুন ও প্রচলিত আইনের প্রতি অনেক সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা হয়। প্রকিউরমেন্টের জন্য যেই সকল বিধিবিধান রহিয়াছে, তাহা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করিলে এমন হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি হইত না।
উন্নয়নশীল বিশ্বে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ রকমের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। ই-টেন্ডারিং এই পরিস্থিতির উন্নতির বিধান করিতে পারে নাই। এমনকি অনেকে সার্বিক পরিবেশ বিবেচনায় লইয়া কোনো কোনো টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণই করিতে চাহেন না। টেন্ডার ড্রপ করিতে গেলে অনেক সময় তাহাদের নিরুত্সাহিত করা হয় বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। ইহা লইয়া ঘটে দাঙ্গাহাঙ্গামাও। ফলে দিনশেষে ঐ সমস্ত লোকই কাজ পান, যাহারা সরকারের সাঙ্গপাঙ্গ ও সরকারকে ক্ষমতায় আনিতে কোনো না কোনোভাবে সহায়তা করিয়াছেন। কথা এখানেই শেষ নহে। দেখা যায়, সরকারি দলের গুটিকয়েক লোকের হাতেই শেষপর্যন্ত সরকারি কাজের নিয়ন্ত্রণ চলিয়া যায়। ইহাতে যাহারা ক্ষমতার বাহিরে তাহারাই শুধু নহেন, সরকারি নিজ দলের সমর্থক অনেক ব্যবসায়ীও প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ পান না। তাহাদের এই বঞ্চনার কারণে খোদ সরকারি দলের ভিতরও ক্ষোভ বাড়িতে থাকে। এই সকল দেশে আসলে লুম্পেন অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। কেননা ক্যাপিটাল ফরমেশন তথা পুঁজি গঠনে লুটপাটতন্ত্রই এখানে মুখ্য। এই কারণে আমরা দেখিতে পাই, এই সকল দেশে বহু ক্ষেত্রে বত্সরের পর বৎসর সরকারি রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজ পড়িয়া থাকে। অনেক সময় কাজ না করিয়াই বা কিয়দংশ করিয়া বিল উঠাইয়া লওয়া হয়। বিল না দিলে সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। এমনকি শারীরিক আক্রমণের নজিরও কম নহে। ইহার জন্য চলে নানা অনৈতিক দেনদরবার ও যোগসাজশ রক্ষা। কার্যাদেশের ধরন পরিবর্তন, দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করা, দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবহেলা, নম্বর বাড়াইয়া-কমাইয়া আনুকূল্য প্রদান, ঠিকাদারদের রেট শিডিউল জানাইয়া দেওয়া, কাজ তদারকি ও অগ্রগতি প্রতিবেদনে ভুল তথ্য প্রদান, কাজ সম্পন্নের পর বিল দেওয়ার সময় ঘুষ গ্রহণ, ই-জিপির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব ইত্যাদির সুযোগে ঘটিতেছে এই সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি।
কী দুর্ভাগ্য উন্নয়নশীল বিশ্বের! এই সকল দেশে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিবিধান আছে ঠিকই; কিন্তু তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হইতেছে না। মোটা দাগে এই সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে রাজনৈতিক ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর কঠিন হইয়া পড়িতেছে বারংবার। এই সকল দেশে যাহারাই ক্ষমতায় আসেন, তাহারাই যেন একপ্রকার বাঘের পিঠে সওয়ার হন এবং দেশে বিরাজ করে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। অথচ এই সকল দেশের আমলাতন্ত্র যদি তাহাদের মতো এবং আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করিত, তাহা হইলে এই সংকট যত দ্রুত হওয়ার কথা, ততটা দ্রুততর হইত না।