শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আঘ্রাণের স্মৃতি

আপডেট : ২১ মে ২০২৩, ১৬:৪৮

সমুদ্রের সঙ্গে আমার দেখা বারো বছর পর। বাবা-মায়ের সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে এসেছি বেড়াতে। কে জানত, এখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করে রয়েছে? অপেক্ষা করে রয়েছে ফেলে আসা অতীত, অবসাদ, ব্যথা, বিদ্বেষ, প্রথম প্রেম...। হ্যাঁ, সমুদ্রের সঙ্গে জীবনের একটা পর্যায়ে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছিল। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম, সেও আমায় ভালোবেসেছিল। তখন আমার বয়স পনেরো বছর। আমরা নিয়মিত চিঠি লিখতাম। কিন্তু তখনো তাকে ভালোবাসিনি। এরপর এসএসসির টেস্ট পরীক্ষার সময় আমাদের দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। সে-সময়ই আমি তার জন্য কেমন উতলা উন্মাদিনী হয়ে উঠলাম। পড়ালেখা করতে পারতাম না, খেতে পারতাম না, রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না। সারাক্ষণ কেবল চোখের সামনে ভাসত সমুদ্রের গভীর কালো কথাভরা চোখ দুটি। আমার এক বন্ধুর হাতে সে আমাকে শেষ চিঠিটি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠির উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম, আমিও তাকে ভালোবাসি। এরপর আমাদের আর যোগাযোগ হয়নি।

এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে এখন।

বিকেলে একা একা রিসোর্টের বাইরে বেরিয়েছি। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। হাতে নীল রঙের ছাতা। খালি পায়ে এসেছি। মেঘকুয়াশায় আর্দ্র হয়ে থাকা গুচ্ছগুচ্ছ ঘাসের ওপর পা ফেলে হাঁটছি। আমাকে ঘিরে ঘুরে ঘুরে উড়ছে মেঘ। ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার শাড়ির আঁচল, কুণ্ডলিত চূর্ণকুন্তল, আঁখিপল্লব। হাঁটতে হাঁটতে কোথায়, কতদূরে চলে এসেছি নিজেও জানি না। হঠাত্ কেউ একজন যেন আমার নাম ধরে ডাকল। কণ্ঠস্বরটি অত্যন্ত পরিচিত হলেও আমি সহসা বুঝতে পারলাম না কে ডেকেছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম—অদূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সমুদ্র! তার ঠোঁটের কোণে উষ্ণ হাসি।

এত বছর পরে দেখলাম, অথচ তাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হলো না। সেই চিরচেনা মুখ, কৌতূহলী চাহনি, অজস্র কথায় পূর্ণ দুটি চোখ, সপ্রতিভ হাসি। কিন্তু কোথায় যেন কিছু ভুল হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে একটুও বড় হয়নি। তাকে শেষবার যেমন দেখেছিলাম এখনো তেমনই দেখছি। তার বয়স আটকে আছে ষোলোতে।

আমি অস্ফুটে উচ্চারণ করলাম, সমুদ্র!

সে হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল, কেমন আছ, নীলিন্দ্রা?

ভালো আছি—আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

এই আছি বেশ।

তুমি একেবারে আগের মতোই আছ।

তুমিও কিন্তু তেমন একটা বদলাওনি।

আমি প্রসঙ্গ পালটে বললাম, এখানে কী করছ? ঘুরতে এসেছ বুঝি?

না, এখানেই থাকি। একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই। তুমি?

আমি বেড়াতে এসেছি। আগামীকাল চলে যাব।

কার সঙ্গে এসেছ?

বাবা-মায়ের সঙ্গে।

বিয়ে করনি?

না।

আমি এক মুহূর্তে ইতস্তত করে জিগ্যেস করলাম, তুমি? তুমি বিয়ে করেছ?

এখনো হয়ে ওঠেনি।

রিয়ার সঙ্গে তোমার এখনো সম্পর্ক রয়েছে?

তুমি শুনেছিলে?

হ্যাঁ। সেই যে তুমি উধাও হলে, অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও যখন তোমার টিকিটির দেখা মিলল না, হঠাত্ একদিন মৃণালিনীর মাধ্যমে তোমার খোঁজ পেয়ে গেলাম। শুনলাম রিয়ার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়েছ।

চল, তোমাকে একটা সুন্দর জায়গা দেখাব। আপত্তি নেই তো?

একেবারেই না।

আমরা বেশ কিছুদূর হাঁটলাম। সমুদ্র আমাকে একটি পথের প্রান্তে নিয়ে এলো। আঁকাবাঁকা পথটি চলে গিয়েছে যতদূর দৃষ্টি যায়। পথের এক পাশে গাছের সারি, পত্রপল্লবে জায়গাটি ছায়াচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। চারিদিকে কুয়াশার মতো মেঘের ভিড়। পথের এক পাশে সবুজ পাহাড়রাজি, অন্য পাশে খাড়া খাদ। নাম-না-জানা জংলি গাছের নিচে একটি কাঠের বেঞ্চ। সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চটিতে বসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রইল কৌতূকপূর্ণ দৃষ্টিতে।

তার সঙ্গে আমার সময় কাটানো ঠিক হচ্ছে কি না আমি বুঝতে পারছি না। এক যুগ পেরিয়েছে, কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে আমি এখনো সমুদ্রকে ভুলতে পারিনি। এমন নয় যে, আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আসেনি। কিন্তু যারা এসেছে সবার মাঝেই আমি কেবল সমুদ্রকে খুঁজেছি। ফলে প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। কিছুদিন পরে আর কাউকেই ভালো লাগেনি।

আমি ক্ষণিক দ্বিধা করলাম। তারপর ভাবলাম, একটাই তো জীবন। কী হবে এত কিছু চিন্তা করে? এই যে, এত বছর পর আমরা দুজনে আবারো মুখোমুখি হয়েছি, এর পেছনে সৃষ্টিকর্তার মহত্ কোনো পরিকল্পনা নিশ্চয়ই রয়েছে। আমি সমুদ্রের পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, জায়গাটা সত্যিই সুন্দর।

হ্যাঁ, মৃত্যুর মতো সুন্দর।

সমুদ্র হাসল। আর কিছু বলল না। আমিও নীরব হয়ে রইলাম। দুজনেই ডুবে গেলাম আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতায়। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, কিছু নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। এছাড়া জগতে আর কোনো প্রাণের স্পন্দন যেন নেই। এই যে, আমি কিংবা সমুদ্র—আমরাও এখানে নেই। আমরা দুজনেই কোনো অচিন জগতের বাসিন্দা। যেখানে কেবলই ধূসর ঊষরভূমি, ঝরা পাতা, অস্থিমজ্জা কাঁপানো শীত! এই জগত্ আর আমাদের জগতের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। কেবল একটাই মিল—এখানেও থেকে থেকে পাতাঝড় বইছে।

দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অবশেষে আমি বললাম, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের বোধহয় উঠে পড়া উচিত।

চল, তোমাকে এগিয়ে দেই।

না, আমি একাই যেতে পারব। আমি বরং তোমার স্কুলটি দেখার জন্য কৌতূহল বোধ করছি।

চল, দেখিয়ে নিয়ে আসি।

সমুদ্র যে স্কুলটিতে শিক্ষকতা করে সেটি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এরপর কেমন উসখুস করতে লাগল। আমি দ্বিধাবিভক্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করলাম, তুমি কি কিছু বলতে চাও?

কাল কখন যাচ্ছ?

সন্ধ্যায়।

আমি কোথায় থাকি একবার দেখে যাবে? আমার সঙ্গে এক কাপ চা খেলে।

বেশ তো।

সমুদ্র আমাকে স্কুল থেকে কাছেই একটি বাড়িতে নিয়ে গেল। এক কামরার বাড়ি। পরিপাটি করে গোছানো ঘর। সে যখন চা বানাতে গেল, আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘর দেখতে লাগলাম। অকস্মাত্ আমার চোখ পড়ল দেয়ালে টানানো একটা পেইন্টিঙে। আকাশ ফুঁড়ে একটি চোখ বেরিয়ে এসেছে। সেই দীর্ঘ পল্লবঘন চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আনাড়ি হাতের কাজ। ছবির পেছনে লুকোনো বোধটিও হাস্যকর। ছবিটি আমার আঁকা।

আমি দীর্ঘক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছে যেন কোনো পশু আমার বুকের ওপর ভর দিয়ে বসে রয়েছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, গলার কাছে দলার মতো কিছু একটা আটকে আছে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। সমুদ্রকে কিছু না জানিয়েই ছুটে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রিসোর্টের পথ ধরলাম।

রাত থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল, তবু বৃষ্টি থামবার লেশমাত্র আভাস নেই। গতকাল সমুদ্রের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই মনের ভেতরটা কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে রয়েছে। বৃষ্টি সেই স্যাঁতসেঁতে ভাব আরো বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। আমার অসম্ভব অস্থির লাগছে।

হাতে সময় বেশি নেই। যা সিদ্ধান্ত নেবার এখনই নিতে হবে। এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। চলে যাবার আগে আরেকবার সমুদ্রের সঙ্গে দেখা করব। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমি বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।

সমুদ্রের বাড়ি খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো। স্থানীয় লোকজনদের জিগ্যেস করতেই তারা আমাকে পথ দেখিয়ে দিল। সমুদ্র বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে সে একটুও অবাক হলো না, বরং এমনভাবে হাসল যেন জানত, আমি আবারো আসব। গতকাল কিছু না বলেই কেন চলে গিয়েছিলাম সেই প্রসঙ্গেও কিছু জিগ্যেস করল না। কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেবল বলল, চা খাবে?

না। আমি চা খাই না।

একবার খাও। আপ্যায়ন করার মতো আর কিছু নেই।

আপ্যায়ন করতে হবে না।

তুমি আমার সঙ্গে এভাবে রেগে রেগে কথা বলছ কেন?

একটা প্রশ্নের উত্তর দাও—আমাকে আদৌ ভালোবেসেছিলে কখনো?

বুঝতে পারি না ঠিক। মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই একটা ঘোরের মতো ছিল।

ঐ ছবিটি এখনো এখানে কী করছে? এত বছর পর?

ছবিটি সুন্দর, সেই কারণে রেখে দিয়েছি।

আর কোনো কারণ নেই?

আর কী কারণ থাকবে?

আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। উঠি।

তুমি তো আজই চলে যাচ্ছ, না?

হ্যাঁ। রিসোর্টে পৌঁছেই রওয়ানা দেব।

চল, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

দরকার নেই।

অবশ্যই দরকার আছে। চল তো।

আমি আপত্তি করলাম না। এ কারণে নয় যে, আমার বাক্যব্যয় করতে ইচ্ছে করছে না। বরং আমার ইচ্ছে করছে যতটা সম্ভব তার সঙ্গে সময় কাটাতে। আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম।

বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে। সমুদ্র আমার মাথায় ছাতা ধরে থাকলেও নিজে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমার অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিসোর্টের কাছাকাছি এসে আমি হঠাত্ থমকে দাঁড়ালাম। সমুদ্রের দিকে ফিরলাম। কম্পিত হাতে তার হাত ধরে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, সমুদ্র!

সে তার চিরাচরিত হাসি মুখে ধরে রেখেই বলল, আমাকে ভুলে যাওয়াই তোমার জন্য ভালো।

আমার চোখ ভিজে উঠল। ধরা গলায় বললাম, তোমাকে আমি কখনোই ভুলতে পারব না।

আমি এক ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে তার গালে চুমু দিলাম। সে বলল, আর কখনো দেখা হবে না, নীলিন্দ্রা।

কেন?—প্রশ্নটি করা মাত্রই কেউ যেন আমার দুই চোখে দুই পেয়ালা আঁধার ঢেলে দিল। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। নিরবচ্ছিন্ন নিবিড় নিশ্ছিদ্র ঘুম। এই ঘুমের মাঝেও আমি বুঝতে পারছি, পুরোটাই একটা স্বপ্ন। সমুদ্রের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কখনো হবেও না। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পর, কলেজে পড়ার সময় সে বন্ধুদের সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। অথচ কী নিখুঁত তার উপস্থিতির আস্বাদ! এই মাত্র যেন সে আমার মাথার পাশে বসেছিল। এখনো সেখানে তার শরীরের উষ্ণতা লেগে রয়েছে!

[শেখেরটেক, ঢাকা]

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন