মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ও আসন্ন বাজেট

আপডেট : ২২ মে ২০২৩, ০৫:০৪

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্র অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারিতে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কাস্টমস শুল্ক-কর মিলিয়ে মোট আদায় হয়েছে ২৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ সময় রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এতে কীভাবে ঘাটতি পূরণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ বছরের বাকি সময়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনাও কম। গত বছরের নভেম্বর থেকে রাজস্ব আদায়ে এই ভাটা শুরুর পর সেই ধারা অব্যাহত ছিল ফেব্রুয়ারিতেও। ফেব্রুয়ারিতে এসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি জানুয়ারির ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে কমে ৩ শতাংশে ঠেকেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে করজাল বাড়াতে ‘এজেন্ট’ নিয়োগের পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব এজেন্ট দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করযোগ্য আয় এবং টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) আছে—এমন করদাতা খুঁজে বের করবে। একই সঙ্গে তাদের রিটার্ন জমা দিতে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করবে। বিনিময়ে করদাতার প্রদেয় করের একটি অংশ এজেন্টকে কমিশন হিসাবে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে বাজেটে ‘ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারার’ (আয়কর বিবরণী প্রস্তুতকারী বা টিআরপি) নামে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। আমেরিকার মতো উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করদাতাদের সহায়তার জন্য এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা কেন্দ্রীয় রাজস্ব আদায়কারী সংস্থার কাছ থেকে কমিশনের বিনিময়ে নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে এবং তাদের রিটার্ন পূরণে সহায়তা করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমে এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। ঐসব এজেন্টের আওতায় শিক্ষিত তরুণদের করসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেসব তরুণ নতুন করদাতাদের রিটার্ন পূরণে সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশেও সেই মডেল ফলো করে এজেন্ট নিয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে। এ লক্ষ্যেই নতুন বিধিমালাটির খসড়া করা হয়েছে। ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাজেট বৈঠক আছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিধিমালার বিষয়ে ইতিবাচক সম্মতি দিলে অর্থবিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এনবিআর যথাসময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের দেশে বহু শিক্ষিত বেকার রয়েছে যাদের এ কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার স্কাউট রয়েছে, যাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। উদ্যোগটা ইতিবাচক। এদিকে এনবিআর আগামী বাজেটে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। আমরা মনে করি, এই সিদ্ধান্তটা আপাতত সঠিক নয়। ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর আগে যারা কর দিতে সক্ষম, তাদের করের আওতায় আনা জরুরি। গত ২০২২ সালের জুলাই মাসে বিবিএস প্রকাশিত তথ্যে দেখলাম যে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এদিকে বিআরটিএর ২০২২ সালের তথ্যে জানা গেছে যে, দেশের মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এখন অবশ্যই আরো বেড়েছে। কারণ, দৈনিক প্রায় সাড়ে চারের মতো নতুন করে রাস্তায় নামছে। আর বহুতল বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তো কোনো হিসাবই নেই।

এবার আসি আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা ধরা হবে বলে জানা গেছে, যা বাজেটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৫ শতাংশ। বরাবরের মতো এবারও ঘাটতি বাজেট উত্থাপন হতে যাচ্ছে। আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন অনুদান ও বাজেট সহায়তা ফান্ড থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা, দেশীয় ব্যাংক থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকারের অর্থ বিভাগ।

প্রতি বছরেই রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে করে বছর শেষে ঘাটতি দেখা যায়। এ ঘাটতি পূরণে সরকার ঋণ নিতে বাধ্য হয়। অথচ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আদায়ের মাধ্যমে অনেকখানি ঘাটতি সামাল দেওয়া সক্ষম। বহুকাল ধরে রাজস্ব আয় আদায়ে তৎপরতা বৃদ্ধির কথা বললেও দিন শেষে কেন বাজেটে এ খাতে ঘাটতি থেকে যায়? মূলত ১৯৯১ সালে ভ্যাট আইনের পর দেশের রাজস্ব খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখনো মান্ধাতার আমলের নিয়ম মেনে কর ও রাজস্ব আদায় করা হয়। এতে করে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয় না। অনেক সময় দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতেই এনবিআরের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে প্রতি বছর বড় রকমের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।

আমাদের এ মুহূর্তে একটি সংযত বাজেট দরকার। বড় রকমের ঘাটতি বাজেট দিলে পরে গিয়ে এ বাজেট বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচনি বছর হিসেবে সরকার স্মরণকালের বড় বাজেট দিলেও এটি সামাল দেওয়া ও ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের ওপরে নির্ভরশীল না হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মূল কথা বাজেট ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড

 

ইত্তেফাক/ইআ