রোববার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সেলফিগাথা

আপডেট : ২৫ মে ২০২৩, ০৪:৩৭

শ্রীমান অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহারাজ এই যে দিন-রাত অনবরত সবার মুখে একটাই শব্দ শুনতে পাচ্ছি ‘সেলফি’। এটি কী রূপ? এটি খায় না অঙ্গে মর্দন করে?’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটু বক্র হাসি দিয়ে বললেন, উত্তম প্রশ্ন বৎস। খুবই রুচিকর আর আকর্ষণীয় এই বস্তু। এর পেছনের ইতিহাসও অতি মনোরঞ্জক। ধরাধামে কলিকালে একধরনের প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে, যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করে। আকৃতিগতভাবে মানুষদের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও বাকি সবই ভীষণরকম বিসদৃশ। আসল মানুষ যেখানে ফুল, পাখি, গাছ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, প্রকৃতি দেখতে ভালোবাসত, এই মনুষ্যসদৃশ জীব শুধু নিজেদেরই দেখতে ভালোবাসে। এরা খুব সম্ভবত বেদান্তের ‘আত্মানং বিদ্ধি’ এবং গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের ‘নো দাইসেলফ’ অর্থাৎ ‘নিজেকে জানো’ এই মহান শ্লোক ও বাণীর অনুসারী। তাই এরা নিজেকে জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কোণ থেকে, বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে দেখতে উত্সাহী। এই নতুন প্রজাতির মানুষকে উত্তরমানব বা প্রায়-মানব বলা হয়। নিজেকে জানার এই ইচ্ছা এদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর এবং অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে। 

প্রথম প্রথম এরা নিজেকে দেখার সাধ পূর্ণ করতে চিত্রকরকে দিয়ে নিজেদের চিত্রিত করাত। অর্থাৎ নিজের ছবি আঁকাত। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল বলে বেশির ভাগ প্রায়-মানবকেই আয়নায় নিজের মুখ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। পরে এরা এদের উর্বর মস্তিষ্ক খাটিয়ে একধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলে যার নাম ‘চিত্র বন্দি যন্ত্র’। অর্থাৎ এটা একধরনের ছবি ধরার ফাঁদ। এই অত্যাশ্চর্য যন্ত্রের সাহায্যে যে কোনো দৃশ্যকে ফাঁদে ফেলে বাক্সবন্দি করা যায়। কোনো কিছুর দিকে এই যন্ত্র তাক করে একটি বোতাম টিপলেই ব্যস। সুড়সুড় করে সে দৃশ্য এসে বাক্সের মধ্যে ঢুকে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বাক্সের দরজা বন্ধ আর ছবি বাক্সবন্দি। সে ছবি তখন বাক্সের মধ্যে যতই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করুক না কেন, বাক্স থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই।

কিন্তু প্রথম প্রথম সে যন্ত্র আয়তনে বৃহত্ হওয়ায় নিজের দিকে তাক করে বোতাম টেপার সুবিধে হতো না। তখন সাগরে, পাহাড়ে জাদুঘরে, বাজারে সর্বত্র যে কোনো চেনা-অচেনা-অর্ধচেনা লোক দেখলেই এই প্রায়-মানবদের বলতে শোনা যেত, ‘ভাই, আমার একটা ছবি তুলে দিন না’ বলে তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই সেই ছবি বন্দি করার কলটা তার হাতে তুলে দিয়ে হাসিমুখে, ঘাড় বেঁকিয়ে বিভিন্ন নৃত্যবিভঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ত। এইভাবেই কিছুকাল ধরে এরা নিজেকে দেখার এবং জানার তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। কিন্তু অপরের সাহায্যের প্রয়োজন থাকায় সর্বতোভাবে নিজেকে জানতে পারছিল না অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমাণে নিজের ছবি তুলতে পারছিল না এবং এ কারণে অবসাদে ভুগছিল। ক্রমে ক্রমে এই যন্ত্র ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আমের আঁটির মতো ছোট হলো। এবং প্রায়-মানবদের আরেক আবিষ্কার দূরভাস যন্ত্রের মধ্যে স্থান পেল। তখন ঐ যন্ত্র নিজের দিকে তাক করেও নিজের চিত্র বাক্সবন্দি করা সম্ভব হলো। তখন প্রায়-মানবেরা সর্বপ্রকারে নিজেকে জানতে প্রয়াসী হলো। সময়-অসময়, সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নায় এরা নিজেদের পানে ঐ যন্ত্র তাক করে নিজেদের ছবি তুলতে লাগল। এটাই ‘সেলফি’। সেলফ থেকে সেলফি। অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পেরে তাদের আনন্দের কোনো শেষ রইল না। এখন মন্ত্রী থেকে যন্ত্রী, নেতা, মুচি-কসাই, চোর-লম্পট থেকে শুরু করে নায়িকা-গায়িকা-খেলোয়াড়, চাওয়ালা, পকেটমার, পুঁজিপতি, শিল্পপতি, ঋণখেলাপি, সবাই ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া সর্বক্ষণ সেলফি তুলতে থাকল।

এমনকি কিছু কিছু প্রায়-অতিমানব গতিমান ট্রেনের সামনে বা উঁচু ব্রিজের ওপরে, পাহাড়ের খাদে, বিপজ্জনক দুরূহ সব স্থানে দাঁড়িয়ে সেলফি দ্বারা নিজেকে জানার প্রয়াস নিয়ে হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হলো না। শুধু তা-ই নয়, তারা এই পর্বতপ্রমাণ সেলফি সবাইকে তাদের আরেক উদ্ভাবন ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে মর্ত্যলোকের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে একই সঙ্গে এরা সব ভূভাগে দৃশ্যমান হলো এবং একধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সবাই একে অন্যকে অপূর্ব সুন্দর কিংবা সুন্দরী বলে বাহবা দিয়ে নিজেদের আত্মগরিমা পুনঃপুন উজ্জীবিত করতে থাকল। তখন প্রায়-মানবেরা সোহম অর্থাৎ ‘আমিই সেই ব্রহ্ম’ সেই পরম বোধে উত্তীর্ণ হয়ে আত্মজ্ঞানী হলো। সচ্চিদানন্দের কৃপায় সৎ অর্থাৎ নিজের অস্তিত্বকে জানান দিতে নিজের চিত্শক্তি অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তির সহায়তায় সেলফি আবিষ্কার করে এই প্রায়-মানবেরা আনন্দ লাভ করল এবং অনন্ত-আনন্দ-কারণ-সাগরে নিমজ্জিত হলো।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা শ্রীমান অর্জুন কতক বুঝল, কতক বুঝল না। তাই সে আবার প্রশ্ন করল, কিন্তু সেলফির নেশা কেন সৃষ্টি হলো? আর এই গোষ্ঠী পৃথিবীর শত শত ধর্মগ্রন্থ ও মনীষীর লক্ষ-কোটি বাণী উপেক্ষা করে কেবল ‘নো দাইসেলফ’ দ্বারা কেন উজ্জীবিত হলো প্রভু?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবার স্কুলশিক্ষকের মতো বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেন। বললেন, শোনো বত্স, প্রায়-মানবেরা  সেলফ আইডেনটিটি বা আত্মপরিচয় গড়তে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের সমাজ বেশির ভাগ সময়ে সে কী পারে না, সেটাই বড় করে দেখায়। ছোটবেলা থেকে এমন পরিবেশে বড় হলে আত্মসম্মান বা সেলফ এসটিম তৈরি হয় না। হীনম্মন্যতা গড়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে প্রজেক্ট করার প্রবণতা তৈরি হয়। স্বীকৃতি চাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘লাইক’ পাওয়ার প্রবল ইচ্ছেটা আসে এখান থেকেই। এটাই পাওনা। আর এটাই নেশা হয়ে উঠছে একটা সময়। কত ভাবে নিজেকে প্রজেক্ট করা যায় ভেবে চলেছেন অনেকেই। ঝুঁকি নিয়েও নিজেকে অন্যভাবে প্রজেক্ট করার প্রবণতা আসছে। ফলে মাঝেমধ্যেই নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। শুধু ভারতবর্ষই নয়, বিশ্ব জুড়েই ঘটছে। দক্ষিণ আমেরিকায় র‍্যাটেল স্নেকের সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়ে একজন মারা গেছে। এই প্রজাতিটি ভাবনাচিন্তা না করে হঠকারিতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। নিজেকে প্রজেক্ট করার তীব্র নেশাই যার মূলে।

নিজের বলতে যতটা বা যা কিছু বোঝায়, পেটাই শরীর, প্রসাধন-লালিত মুখশ্রী, উচ্ছ্বসিত বন্ধুদল, অর্জিত সম্পত্তি, লব্ধ পণ্য, সব এখন এই সেলফির আওতায়। যা কিছু নিজের নয় তাও তার গণ্ডিবদ্ধ:সাগরে বিমানে পাতালে, রাস্তায় বা রেস্তরাঁয় সবাই মগ্ন এক দৃশ্য-সাধনায়। শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে বেঁকে, অনবরত এক হাত প্রসারিত করে নিজের ছবি তুলে, তাতে রং চড়িয়ে ও তক্ষুনি বিলিয়ে এই প্রায়-মানবরা মগ্ন রয়েছে এক নেশাতুর ডিজিটাল-ক্রিয়ায়।

নিজেকে নিয়ে, নিজেকে দিয়ে, নিজেকে দেখার ও দেখানোর এই প্রবণতা এক আশ্চর্য ব্যাধি। যার কারণে এই প্রায়-মানবদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, মুহূর্তগামী, সদা মন্তব্যপিপাসু, অধিকাংশ সময় তা অপরমুখী।

এই প্রায় মানবদের মননে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সাম্য ও গণতন্ত্রের অভাব প্রকট হলেও যন্ত্র ব্যবহারে গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে। ফলে জনসাধারণের হাতে এসেছে সেই দৃশ্যযন্ত্র এবং ছবি তোলার চরম সুবিধা, এক দশক আগেও যা ছিল বিশেষজ্ঞদের জিম্মায়। ক্ষমতার হাত ধরে এসেছে সমতা, সেই সঙ্গে ঘুচেছে ফটোগ্রাফার ও নন-ফোটোগ্রাফারের তফাত ও দূরত্ব। সবার হাতেই এখন ক্যামেরা। সবাই ছবি তুলতে সক্ষম, সবাই ফটোগ্রাফার।

সেলফিগ্রস্ত তাদের এই সভ্যতা নিজেকে দৃশ্যপণ্যে পরিণত করে ও তাকে বিতরণ করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সদা উন্মুখ। প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তই এখন প্রচারযোগ্য ও মন্তব্যকামী; নিজের অস্তিত্ব, সঙ্গ ও একাকিত্বকে সেলফির মাধ্যমে সম্প্রচার করাটা দাঁড়িয়েছে অভ্যাসে। দৃশ্যগতভাবে নিজের ওপর নিজের ও অন্য সবারই রয়েছে কড়া আত্মপ্রহরা, যা একদিকে নিতান্ত নাছোড়বান্দা, অন্য দিকে চূড়ান্ত নজরবন্দি।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আত্মমগ্ন হয়ে কথাগুলো বলছিলেন। সংবিৎ ফিরে পেতে অর্জুনের দিক তাকালেন। দেখলেন অর্জুন শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তিনি ভাবলেন, হয়তো ক্লান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কাছে গিয়ে ভালো করে পরখ করে দেখলেন, সেলফিগাথা শুনতে শুনতে অর্জুন আসলে সংজ্ঞা হারিয়েছেন!

লেখক : রম্যরচয়িতা

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন