সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১ জুন জাতীয় বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এই বাজেট নিয়ে সবার মধ্যেই একধরনের উত্কণ্ঠা লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ আগামী অর্থবছরের বাজেট এমন সময়ে ঘোষিত হতে যাচ্ছে, যখন বিশ্ব অর্থনীতি নানা সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ কোনো কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে আর কখনো প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে কোনো ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতির ওপরই পড়ে। শুধু বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেই নয়, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, এর জন্য মূলত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থাই দায়ী। কারণ বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এই অবস্থাকে ঠিক মন্দা বলা যাবে না, তবে প্রায় মন্দার কাছাকাছি চলে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু বর্তমানে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে, এই সুযোগে স্থানীয় একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় রয়েছেন। আন্তর্জাতিক যেসব কারণে বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, সরকার চাইলেও তা সমাধান করতে পারবে না। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে, সরকারের সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
যে কোনো বাজেটের দুটি দিক থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফিস্ক্যাল দিক আর একটি মানিটারি দিক। বাজেটে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব দিকই বিবেচনায় নিতে হয়। বাজেটের মূল লক্ষ্য থাকে কয়েকটি। যেমন—জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হবে, মূল্যস্ফীতি কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে এবং দারিদ্র্যবিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে। করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল, তখনো বাংলাদেশ উচ্চ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করে, তারা সরকারের প্রাক্কলনের চেয়ে কিছুটা কম জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে মত প্রকাশ করেছে। অর্থবছর শেষ হতে এখনো এক মাস বাকি আছে। আমাদের চূড়ান্ত অবস্থা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে, তার কাছাকাছিই অর্জিত হবে। আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত পণ্য রপ্তানি আয় গত কয়েক মাস ধরে কিছুটা নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও কিছুটা কমেছে। এখানে সরকারের কিছু করণীয় আছে। ব্যবসায়ীদেরও করণীয় আছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে রপ্তানিকারকদের সহায়তা দেওয়া হতো এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) আওতায়। এই ফান্ডের আকার ছিল ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু সেই সহায়তা ফান্ডের আকার পৌনে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কমিয়ে আনা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সৃষ্ট রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার কিছুটা কমানো হলেও পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে, যার নামকরণ করা হয়েছে প্রি-ফাইন্যাসিং ফান্ড। ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদ হারে এই ফান্ড থেকে রপ্তানিকারকদের অর্থ দেওয়া হবে।
সরকার ও ব্যবসায়ীরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর জন্য। এজন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে, যা পোশাক রপ্তানিকারকগণ বলে থাকেন। বাংলাদেশ যে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, তার মূল্য নির্ধারণ করে আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতারা। কাজেই অনেক সময় প্রচুর পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করেও তুলনামূলক কম মূল্য পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের বড় ধরনের একটি সমস্যা রয়েছে, তা হলো পণ্য রপ্তানিকালে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। আবার আমদানিকালে অভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বেশি অর্থ নিয়ে বিদেশে পাচার করছেন। এ কারণে যতটা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার কথা, তা আসছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার সতর্ক রয়েছে। আমি আশা করব, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশ সাংঘাতিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সংকটে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে কোনো জটিল সমস্যায় পড়বে। সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ হচ্ছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। যদি রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে দেওয়া রিজার্ভ অর্থ বাদ দেওয়া হয়, তাহলে রিজার্ভের নিট পরিমাণ দাঁড়াবে ২৪ থেকে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বশেষ আমার জানামতে, আমাদের মাসিক আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, কোনো দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকলেই তাকে স্বস্তিদায়ক বলে মনে করা যেতে পারে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের চেষ্টা করতে হবে কীভাবে ভবিষ্যতে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানো যায়। পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুত্সাহিত করতে হবে। তবে আমাদের শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে, যাতে শিল্পের উৎপাদন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। কারণ শিল্পের গতি যদি ঠিক না থাকে, তাহলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই দেশে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
বর্তমান সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে চলেছে, তা অব্যাহত রাখার জন্যও দ্রুত ও সুষম শিল্পায়ন প্রয়োজন। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। তবে আমাদের দেখতে হবে, ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ যাতে শিল্প খাতে ব্যয় করা হয়। ঋণের অর্থ কেউ যাতে বিদেশে পাচার করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করতে হবে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে অর্থ উপার্জন করছে তা যাতে সঠিকভাবে বৈধ চ্যানেলে দেশে আসে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার দেওয়া হচ্ছে ১১০ টাকা। আর পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে ১০৬ টাকা। সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তাতে তাদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যাপারে উত্সাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কী কারণে এমনটি হচ্ছে, তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। বিশেষ করে কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশকে যে ঋণ দেওয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে, তার পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণদানের জন্য অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি। সেই ঋণ আবার একবারে দেওয়া হবে না। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণ বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড় করা হবে। প্রথম কিস্তি হিসেবে প্রায় ৪৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওয়া গেছে। এই ঋণ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব একটা স্ফীত হবে না। তার পরও এই ঋণের গুরুত্ব আছে। আইএমএফ কোনো দেশকে ঋণ দিলে অন্যান্য দেশ ও সংস্থাগুলো সেই দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়।
আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা। আর একটি শর্ত হচ্ছে দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানো। এ দুটি বিষয়ে আইএমএফকে বলতে হবে কেন? এটা তো আমাদের নিজেদের স্বার্থেই করা প্রয়োজন। আইএমএফ কয়েকটি শর্ত দিয়েছে, যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন—বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। বিদ্যুৎ এমন একটি উপকরণ, যার অভাবে সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন কমে যেতে পারে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে। ইতিমধ্যে বিদ্যুতের মূল্য বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। আমি আশা করব, বিদ্যুতের মূল্য আর বাড়ানো হবে না।
যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তারা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। তারা কারা, আমাদের জানা আছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারছি না। যারা খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্বে আছেন, তাদের আরো তৎপর হতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যদি চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে অন্যরা সাবধান হয়ে যেত। আমি মনে করি, আসন্ন জাতীয় বাজেটে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
অনুলিখন : এম এ খালেক