মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

হাসনুহেনা

আপডেট : ২৯ মে ২০২৩, ১৩:১৮

গত ছমাস ধরেই রীতা প্রায়ই মাঝরাতে ভয় পেয়ে ঘুমের মধ্যেই চেঁচিয়ে ওঠে। আজও আবার সেই অবস্থাই হলো। ঋভু তাকে ঠেলে ঘুম থেকে জাগায়। জেগে গিয়ে রীতা প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরে ঋভুকে। বেচারি সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে। ধীরে ধীরে রীতার চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, ‘বেশি ভয় পেয়েছ?’

রীতা শিশুদের মতো করে বলে, ‘হুম’।

‘আবার একই স্বপ্ন দেখেছ? আজ রাতের ওষুধ ঠিকমতো খেয়েছিলে?’

রীতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

‘চলো, বারান্দায় গিয়ে একটু বসি। পানি খাবে এক গ্লাস? দাঁড়াও পানি আনছি।’

ঢকঢক করে খুব দ্রুত রীতা পানিটুকু শেষ করে। ঋভু পরম মমতায় রীতার হাতটা আলতো করে ধরে দুজনে মিলে বারান্দায় এসে বসে। ছোট্ট একচিলতে বারান্দাটায় বেশ খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কদিন পরই পূর্ণিমা বোধহয়! রীতার প্লানটেশনের খুব শখ। নানা রকমের গাছপালা দিয়ে বারান্দাটা ভরতি। সেসব গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো জমে জমে এক অদ্ভুত আবছায়া আঁকিবুঁকি তৈরি করেছে বারান্দাজুড়ে। ঋভু কোমল গলায় বলে, ‘এবার একটা সিদ্ধান্ত নাও রীতা, নতুন করে জীবনটাকে শুরু করো। কেন যে পড়ে আছ আমার এই অভিশপ্ত জীবনে!’

রীতা জুবুথুবু করে বসে আছে। ঋভু বার কয়েক বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি একটু বসো, আমি গিটারটা আনছি।

গান গাইতে গাইতে ঋভু দেখল রীতা একটা গাছের সামনে খুব উবু হয়ে বসে কী যেন দেখছে। গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী গাছ ওটা?’

‘ক্যাকটাস। জানো, এই এপিফিলাম গোত্রের ক্যাকটাসে চমত্কার কড়া মেজেন্টা রঙের ফুল ফোটে। অথচ সে বলেছে, এই তরতাজা গাছটা নাকি মরে গিয়ে এখানে একটা হাসনুহেনা গজাবে।’

‘ক্যাকটাসের আবার ফুল হয় নাকি? এইসব কাঁটাওয়ালা গাছগুলা নিয়ে যে তোমার কী আদিখ্যেতা?’

ঋভু আবছা আলোয় ঠিকই রীতার আহত মুখটা দেখতে পায়। রীতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গাছটার কী যেন দেখছে! ঋভু আশা করেছিল, খোঁচাটা খেয়ে রীতা সেই আগের মতো ঝগড়া শুরু করবে আর ক্ষণিকের জন্য হলেও ভয় ভুলে যাবে।

কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। রীতা চন্দ্রাহতের মতো উবু হয়ে বসে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে, এক হাজার পঁচানব্বই রাত পর সে আসবে। সত্যিই আসবে। সেজন্যই তো রোজ পরীক্ষা করে দেখি, এই গাছের গোড়ায় অন্য কোনো গাছ উঠছে কি না! আরে ধ্যাত! তোমার কোন টবে কী গাছ লাগিয়েছ, সে তো তুমি জানোই। ক্যাকটাস মরে গিয়ে হাসনুহেনা হয় নাকি!

ঋভু এবার রীতার কোমরে আলতো হাত রেখে ওকে টেনে তুলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, চলো চলো ঘুমাবে। কাল আমার অফিসে জরুরি কাজ আছে।

ঋভু ভেবে রেখেছে কাল রিপনকে বলবে, তিন-চারদিনের মধ্যে একজন সাইকোথেরাপিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে। শুধু সাইকিয়াট্রিস্টের ওষুধে কাজ করছে না, ওর থেরাপি দরকার। ঋভু মনে মনে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। তার জন্যই রীতার জীবনটা এমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তার নিজের জীবনটাও তো আড়াই বছরে কম দুর্বিষহ হয়নি! তবুও সে নিজেকে খানিকটা সামলে রেখেছে, কিন্তু রীতা কিছুতেই পারছে না।

২. ঋভু যার মুখোমুখি হয়েছে আজ এধরনের মেয়ে দেখলে, বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে ওঠে। কেমন অদ্ভুত ব্যথার মতো হয়, ঋভুর সেই অনুভূতিটাই হচ্ছে এখন। ঋভুর সামনে অপূর্ব সুন্দরী একজন মহিলা বসে আছেন। সে আসলে মনোযোগ দিয়ে যত না সুন্দরীর কথা শুনছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখছিল। মহিলার চোখমুখ যেন কথা বলে! রূপবতীর চোখের কাজল তার চোখজোড়াকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। মহিলা যখন তর্জনী নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন তখন আঙুলের রুবি বসানো রিংটা বারবার ঝিকিয়ে উঠছে। কেমন চেনা একটা প্যাটার্ন!! কিছু একটা মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছে না।

এক ঘণ্টা রীতার সঙ্গে কথা বলার পর, রীতাকে অন্য ঘরে রেখে মহিলা এবার আলাদা করে ঋভুকে নিয়ে পড়লেন। ঋভু অন্যমনস্ক বুঝতে পেরেই যেন মহিলাটি একটু গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কী বোঝাতে চাইছি?’

‘হুম’, ছোট্ট জবাব দেয় ঋভু। সে আসলে তেমন কিছুই শুনছে না, সাইকোথেরাপিস্ট মহিলাটিকে খুিঁটয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ভর সন্ধ্যাবেলাতে হলুদ বাতির আলোতে এই অসম্ভব রূপবতী মহিলাকে দেখে তার কেমন অশরীরী বলে মনে হচ্ছে।

‘আপনার স্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী আজকে সেই এক হাজার পঁচানব্বইতম রাত মানে তিন বছর। মেয়েটি আজ আসবে, তাই না?’

‘জি। ও তা-ই বিশ্বাস করে। আজকেই উচ্ছলার সাথে পরিচয়ের আমার তিন বছর পূর্ণ হবে।’

‘ঘটনাটা আপনি যদি আপনার নিজের মুখে বলতেন!’ মহিলা ঋভুর দিকে তীক্ষ চোখে তাকায়। চেম্বারটা বেশি শুনসান। চারিদিকে পর্দা দিয়ে ঢাকা। টিমটিমে হলুদ আলোয় কেমন যেন গা ছমছমে।

‘আপনি তো নিশ্চয়ই সবই আমার স্ত্রীর কাছে থেকে শুনেছেন। উচ্ছলা নামের একটি মেয়ের সাথে আমার ফেইসবুকে পরিচয় হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটির প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। বেশ দ্রুতই আমাদের মধ্যে গভীর প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

‘প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হয়, সেদিনটা অপূর্ব ছিল। একজন পুরুষের যেমন যেমন কামনা থাকে উচ্ছলা ঠিক সেরকমই ছিল। যাকে বলে একদম ফ্ললেস। দেবীর মতো অপার্থিব তার চলাফেরা। সেদিনই দুজন মিলে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম। ঢাকার অদূরেই একটা হোটেলে একান্ত নিবিড় সময় কেটেছিল আমাদের। এত অপূর্ব রাত আর কখনোই আসেনি এ জীবনে। সেই অসম্ভব ভালো লাগার রাতটাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের বিশেষ মুহূর্তটুকুতে চারিদিক হাসনুহেনার তীব্র গন্ধে ভরে উঠেছিল। সকালবেলা রওনা হবার আগে আমি উচ্ছলার কাছে এরকম আরেকটা রাত ধার চেয়েছিলাম। উচ্ছলা বলেছিল, আমাদের সম্পর্কের যেদিন একহাজার পঁচানব্বই রাত হবে তখন আমরা উদযাপন করব। সেই রাতটায় চারিদিক পূর্ণিমায় ভেসে যাবে দেখো।’

‘পরদিন ফিরে আসতে গিয়ে আমার গাড়িটা খুব বড় একটা অ্যাক্সিডেন্টের কবলে পড়ে। আমার কিছুটা ক্ষতি হলেও উচ্ছলা পথেই মারা যায়। বিশাল নিউজ এবং অনেক হাঙ্গামা হয়েছিল তখন ঘটনাটা নিয়ে।’

‘কিন্তু আপনাদের দুজনের খুব গোপন কথাগুলো সব আপনার স্ত্রী জানলেন কী করে? আপনি বলেছেন?’

ঋভু ভেঙে পড়া গলায় বলে—‘না, উচ্ছলা মারা যাবার কিছুদিন পর থেকেই সে রীতার স্বপ্নে আসে। রীতাকে আমাদের সব খুঁটিনাটি কথা জানিয়ে দেয় এবং আশ্চর্যজনক হলেও সে সবই সত্যি! উচ্ছলা আমার স্বপ্নে কেন আসে না ডক্টর? কেন রীতাকেই ও যন্ত্রণাটা দিচ্ছে? অথচ ঘটনাটা ঘটার আগে রীতা উচ্ছলার ব্যাপারে কিছুই জানত না। থানা-পুলিশ, দুই পরিবারের মধ্যে নেগোশিয়েশন অনেক কিছুই হয়েছিল, কিন্তু আমার আর উচ্ছলার একান্ত ব্যাপারগুলো নিয়ে রীতার সঙ্গে আমার কখনো কোনো কথা হয়নি। সব বাদ দিলেও যেখানে আমার এত বড় বিপদে কোনোভাবেই রীতা আমাকে একা ছেড়ে যায়নি, সেখানে আমি এসব বলে ওকে কীভাবে কষ্ট দেব!’

‘আসলে এত বড় আঘাতটা আপনার স্ত্রী মেনে নিতে পারেননি বলেই মেয়েটির ব্যাপারে তার একধরনের অবসেশন তৈরি হয়েছে। তাই হয়তো আপনার স্ত্রীর ব্রেইন অবচেতনভাবে ঘুমের মধ্যেও নানা ধরনের কাহিনি তৈরি করছে...। খুব বেশি ভালোবাসতেন উচ্ছলাকে তাই না?’

স্মৃতিকাতর ঋভু ভেজা আনত চোখে সাইকোথেরাপিস্টের কথা শুনছিল। হঠাত্ প্রশ্নটা শুনে চমকে তাকায়!

ঋভু দেখতে পায় মহিলা উলটোদিকের চেয়ার থেকে অনেকখানি হাত বাড়িয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলছেন, ‘এই আঙুলটাই তো আমার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তাই না ঋভু! আমার লাশের সাথে ওটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফিঙ্গার রিংটা চিনতে পারছ!’ এক্কেবারে উচ্ছলার গলা।

ঋভুর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায়! আতঙ্কে ছিটকে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। তার ব্রেইনও কী হ্যালুসিনেইট করছে? উচ্ছলার গলা ভুল হতে পারে, আঙুল কাটা পড়েছে, সে কথা পুলিশ, আত্মীয় কিংবা রীতা জানতে পারে—কিন্তু সে যে ভালোবেসে রুবির রিংটা দিয়েছিল সেই রাতে—সেটা তো কারো জানার কথা নয়!

৩.আজ পূর্ণিমা। চারিদিকে জোত্স্নায় থইথই। গভীর রাতে রীতার কান্নার শব্দে ঋভুর ঘুম ভেঙে যায়। কান্নার উত্স ধরে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় গিয়ে দেখে রীতা যথারীতি ক্যাকটাসটার দিকে উবু হয়ে বসে আছে। ঋভু পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই রীতা ফুঁপিয়ে উঠে বলে, আমার এত সুন্দর ক্যকটাসটা নেই ঋভু। ওটা মরে গেছে। রীতার কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে ঋভু দেখে, সত্যিই সকালের হূষ্টপুষ্ট তরতাজা ক্যাকটাসটা পুরোটাই মরে গেছে। আর অদ্ভুতভাবে ক্যাকটাসের গা বেয়ে লম্বা হয়ে একটা হাসনুহেনা ফুলের গাছ গ্রিল ছুঁয়েছে। চাঁদের আলোর মতো হাসনুহেনা ফুলের গন্ধে চারিদিক ভেসে যাচ্ছে। রীতাকে পেছন থেকে আলতো করে টেনে তুলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় ঋভু। একি! রীতা নয়, উচ্ছলা এপিফিলাম ক্যাকটাসের ফুলের মতো গাঢ় ম্যাজেন্টা রঙের একটা শাড়ি পরেছে। অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে। ঋভুর ভয়ার্ত চিত্কারটা উচ্ছলা তর্জনী দিয়ে ঠেকিয়ে দেয়। ঋভুর ঠোঁটে উচ্ছলার আঙুলের কোমল স্পর্শ তাকে কেমন বিবশ করে তোলে। ঠিক তখনই উচ্ছলার আঙুলের রুবিটা চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন