বলা হইয়া থাকে, লোভ মানুষের জীবনের সবচাইতে বড় চালিকা শক্তি; কিন্তু সেই লোভেরও একটি সীমা রহিয়াছে। লোভ যদি সীমা লঙ্ঘন করে তখন তাহার কী পরিণতি হইতে পারে—বিশ্বসাহিত্যে ইহা লইয়া একটি বিখ্যাত গল্প রহিয়াছে। বিশ্বখ্যাত লেভ তলস্তয় তাহার ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ গল্পে দেখাইয়াছেন আদিগন্ত বিপুল ভূমি ক্রয় করিতে গিয়া পাখোম কীভাবে মারা গিয়াছিলেন জমি দখলের একদম শেষ মুহূর্তে। জমি ক্রয়ের শর্ত ছিল, পাখোম ভোর হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতখানি হাঁটিবেন ততখানি জমির মালিক হইবেন তিনি। ‘লোভ’ নামের শয়তান পাখোমকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে হাঁটাইয়া লইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত মূল জায়গায় ফিরিয়া আসিবার অন্তিম ক্ষণে তাহার মৃত্যু হয়। আর মৃত্যুর পর তাহার কবরের জন্য প্রয়োজন হয় মাত্র ‘সাড়ে তিন হাত জমি’।
ভালোভাবে খাইয়া পরিয়া বাঁচিতে একজন মানুষের কত টাকা লাগে? তলস্তয়ের গল্পটির ভাবার্থ আমাদের বুঝাইয়া দেয়, কেহ যদি তাহার সীমা লঙ্ঘন করে তাহা হইলে তাহার পরিণতি হয় ভয়াবহ। আমরা এখন চারিদিকে দেখিতেছি এই সীমা লঙ্ঘনের খেলা। ইহার পরিণতি যে ভয়াবহ হইবেই—তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। অথচ এই ব্যাপারে আমাদের সামনে প্রতিদিনই কিছু না কিছু উদাহরণ তৈরি হইতেছে। গতকালের ইত্তেফাকের ১৫ পৃষ্ঠা হইতেই একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। খবরে বলা হইয়াছে, মাত্র ৯ লক্ষ টাকায় মিলিবে ৯ লক্ষ রিয়াল (সৌদি মুদ্রা)! এত কম দামে এত রিয়াল ক্রয় করিবার সুযোগ হাতছাড়া করিতে চান নাই ডা. এ টি এম মাহবুবুল আলম (ছদ্মনাম)। টাকা পরিশোধ করিয়া রিয়াল-ভর্তি ব্যাগ লইয়া বাসায় ফিরিয়া দেখেন গামছায় মোড়ানো কাগজের বান্ডিল! তিনি মামলা করিয়াছেন এবং পুলিশও দোষীদের গ্রেফতার করিয়াছে; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্য জায়গায়। মানুষের ভয়ানক লোভের সুযোগ লইয়া অনেক দুষ্কৃতকারী এইভাবে অর্থ লোপাট করে। জিনের বাদশা হইতে শুরু করিয়া হায় হায় কোম্পানির কথা শোনেন নাই এমন মানুষ বিরল। বহু বৎসর ধরিয়া অ্যামিবার মতো নানান সময় ভোল পালটাইয়া ইহারা অর্থ লুট করিয়া আসিতেছে সাধারণ মানুষের নিকট হইতে। হায় হায় কোম্পানি কখনো ভুয়া এনজিও, কখন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং তথা এমএলএম, কখনো ভুঁইফোড় কোম্পানির আদলে প্রতারণা ও জালিয়াতি করিয়া আসিতেছে। লুটপাট শেষ হইলে ইহারা রাতারাতি উধাও হইয়া যায়। এই ধরনের প্রতারক চক্রের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের কাহিনি বহু বৎসর ধরিয়া পত্রপত্রিকায় সময় সময় প্রকাশ হইয়া আসিতেছে। প্রশ্ন হইল—দোষ মূলত কাহার? হায় হায় কোম্পানিগুলি তো মানুষের মাথায় বন্দুক ঠেকাইয়া অর্থ আদায় বা তাহাদের পণ্য বিক্রয় করে না। জন্মের পর হইতে হায় হায় কোম্পানির কথা শুনিয়া আসিবার পরও সাধারণ মানুষ কেন তাহাদের ফাঁদে পা দেন?
এক কথায় বলা যায়, ইহার মূলে কাজ করে অতি লোভ। কিছু কিছু ধান্ধাবাজ সাধারণ মানুষকে লোভ দেখায় যে, লোভে পড়িয়া বোকা মানুষ পারিলে ঘটিবাটি বিক্রয় করিয়া উহাদের নিকট আমানত জমা করেন। মাসের পর মাস কিস্তি শোধ করেন। হয়তো কথামতো সামান্য লভ্যাংশ পান, তাহাতে লোভের জিভ আরো চকচক করিয়া ওঠে। একজনের লোভের সামান্য অর্জন দেখিয়া অন্যদের লোভের পাখা জন্মায়। তাহার পর সেই হায় হায় কোম্পানির আগুনে ঝাঁপ দেয় শত শত মানুষরূপী পিপীলিকা। ইহাদের লোভের পাখা জন্মায়ই মরিবার তরে। সকল ধর্মগ্রন্থেই রহিয়াছে লোভ না করিবার। অতি লোভ এক অর্থে নির্বুদ্ধিতাও। সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং অতি লোভ সংবরণই হইল এই ধরনের ঘটনা হইতে মুক্তি পাইবার একমাত্র উপায়। লোভের ফানুসে নিজেকে উড়াইলে আছাড় খাইতেই হয়।