সরকারি চাকরি হলো সোনার হরিণ—এটিই বহুকাল আগ থেকেই এ দেশের সমাজ বাস্তবতায় প্রবাদের মতো প্রচলিত বাণী। এই সোনার হরিণের পেছনেই রাতদিন দৌড়ে বেড়ায় এ দেশের মেধাবীদের বড় অংশ। আর এই সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধাবীদের প্রথম পছন্দই থাকে বিসিএস ক্যাডার।
বিসিএস ক্যাডারের জন্য প্রাথমিক বাছাই থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি করে থাকে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি)। এছাড়াও দেশের সর্বোচ্চ মানের যে সরকারি চাকরি রয়েছে তার সিংহভাগই নিয়োগ সুপারিশের দায়িত্বে থাকে এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। সাধারণত বিসিএসের বাইরেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিগুলোকে প্রধানত নন-ক্যাডার চাকরি বলা হয়ে থাকে। এগুলোর সিংহভাগই এখন বিসিএস উত্তীর্ণদের মধ্য থেকেই সুপারিশ করা হয়। এটিই হয়ে আসছে গত কয়েকটি বিসিএস থেকে। এর সুফল একদিকে যেমন বেকার মেধাবীরা পাচ্ছেন, একই সঙ্গে সরকারও নিয়োগ, বাছাই বাবদ সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি মেধাবী কর্মকর্তা পাচ্ছে। কারণ, এই পদের সুপারিশের শুরুতেই উল্লেখ করা থাকে পদ স্বল্পতার কারণে যাদের ক্যাডার পদে সুপারিশ করা যায়নি তাদেরকেই নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ তারাও ক্যাডার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিন্তু রাষ্ট্রের পদ স্বল্পতার কারণে তাদের যাচাইকৃত মেধা থাকা সত্ত্বেও ক্যাডার পদে সুপারিশ করা যাচ্ছে না। এটাই স্বাভাবিক যে, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে রাষ্ট্র চাইলেও সব মেধাবীদের চাকরি দিতে পারে না। ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বর পাওয়াদের ক্যাডার এবং তত্পরবর্তীদের নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়।
আমাদের মহান সংবিধানের ১৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এখন পর্যন্ত সব চাকরি প্রার্থীর মূল আস্থা এই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ওপর। প্রতিষ্ঠানটিও নিরবচ্ছিন্নভাবে স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয়-লোভনীয় এই সরকারি চাকরির জন্য প্রার্থী বাছাই ও সুপারিশ প্রক্রিয়ার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে থাকে। গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখের অধিক। প্রতিবারই দেখা যায়, আবেদনকারীর সংখ্যা আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রেখে। পিএসসির বর্তমান কমিশন বিসিএস প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করার যে আগাম ঘোষণা দিয়েছে কিন্তু কাজে ঠিক উলটো পথে হেঁটেছে তারা। এই কমিশন এক বছরের বিসিএস সম্পন্ন করার কথা বললেও কোনো কোনো বিসিএসকে টেনে পাঁচ বছরে নিয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, বিধিমালা সংশোধনের নামে যে জগাখিচুড়ি পাকিয়েছে তাতে তাদের হাতে থাকা চলমান ৪০, ৪১, ৪৩, ৪৪, ৪৫—এমনকি আসন্ন ৪৬তম বিসিএসের কোনোটিই তাদের দায়িত্বে শেষ করে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। ২০১৮ সালের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়া ৪০তম বিসিএসের গত আগস্টে একটি নন-ক্যাডার সুপারিশ করলেই প্রায় ৫ হাজার প্রার্থীর চাকরি হতে পারত। কিন্তু তারা সেটি না করে নন-ক্যাডার বিধিমালা সংশোধন আর বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করল। ফলাফল সেই বিধিমালা এখনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে আছে এক বছরের অধিক সময় ধরে।
যেখানে পূর্ববর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলের অল্প সময় পরেই নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হতো, সেখানে এক বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের একটি সুপারিশও করতে পারেননি তারা। প্রার্থীদের পরিবার আর তাদের জীবিকা ঝুলে আছে তাদের একটি সিদ্ধান্তে। অন্যদিকে সরকারি জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরগুলোতে যোগ্য লোকবলের অভাবে। লোকবল চেয়ে চেয়ে হয়রান হচ্ছেন তারা, ওদিকে নাগরিক সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। কী অদ্ভুত প্রক্রিয়া! এই বিধিমালা দিয়েই হাজার হাজার মেধাবী চাকরি পেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে দেশ সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানও সন্তুষ্ট অথচ কী এমন প্রয়োজন হলো যে তাদের সব কাজ ফেলে এই নন-ক্যাডার বিধিমালায় আটকে থাকতে হলো। অথচ জট পাকিয়ে আছে ক্যাডার পদের জন্য প্রক্রিয়াধীন চারটি বিসিএস। আসন্ন আরেকটি বিসিএসও এই জটের বাইরে থাকবে না। ইতিমধ্যে সেটি আগের নিয়মে এ বছর সার্কুলার দিতে পারবেন না বলেই শোনা যাচ্ছে।
একসময় পিএসসির প্রয়াত চেয়ারম্যান ড. সাদত হোসাইন এবং সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক চাকরি প্রার্থীদের পড়াশোনার টেবিলে এনে আস্থা এনেছিলেন পিএসসির। বর্তমানে এসব বিধি জটিলতায় শুধু অনাস্থাই সৃষ্টি হয়নি বরং পিএসসি ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলনও হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
আমাদের বুঝতে হবে নাগরিক সেবার নিমিত্তে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আমাদের এই দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীদের সরবরাহ। দুটিই যেখানে প্রস্তুত সেখানে সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত হয়ে বিধি জটিলতা তৈরি করাটা শুধু বিব্রতকরই নয়, একই সঙ্গে রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কারণ বর্তমান চেয়ারম্যান অনেক ক্ষেত্রেই বলার চেষ্টা করেছেন যে, এর আগে বিধি মানা হয়নি। এর মাধ্যমে তিনি সাবেকদের কাজকেও অবৈধ অথবা নিয়মবহির্ভূত বলারও চেষ্টা করছেন। এটাও সরকারি কর্মচারী বিধিমালায় বহির্ভূত কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। যেখানে এই নিয়মে নিয়োগকারী তথা রাষ্ট্র, সেবাগ্রহীতা নাগরিক এবং তাদের সেবা দানকারী তথা চাকরি প্রার্থীদের সুবিধা হচ্ছে বা কোনো অভিযোগ নেই; সেখানে নতুন বিধিমালার জটিলতা অহেতুক রাষ্ট্রীয় সময় ও অর্থেরই অপচয়। তাই সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে এখনই সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন অহেতুক এসব সিদ্ধান্তে বেকারবান্ধব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ বা বিতর্কিত না হয়।
লেখক : তরুণ প্রজন্মের নাট্যকার ও গবেষক