আমার মেয়ে সব ছেড়ে একজন কেয়ারারের কাজে মনোনিবেশ করেছে। সোশ্যাল ওয়ার্ক করবে বলে একটি গ্রামার স্কুলে রিজাইন দিয়ে এখন বৃদ্ধাদের দেখাশোনা করে। বৃদ্ধারা ওকে যেমন ভালোবাসে, ও তেমনি বৃদ্ধাদের। তাদের নানা গল্প শুনি ওর মুখে। একদিন বললাম, এ দিয়ে তো কাঁড়ি কাঁড়ি গল্প লেখা যায়। বলে, আমি কি লেখক? তুমি লেখো। ও প্রায় দিনই ঐ সব বৃদ্ধার গল্প করে, আমি শুনি।
এক বৃদ্ধার চার ছেলেমেয়ে। কেউ মায়ের কাছে থাকে না। মা একা। ও গিয়ে বৃদ্ধার ওষুধ খাইয়ে দেয়, কিছু আনতে হলে আনে, চা বানায়। কথা শোনে। একদিন ওর কাতর মুখ দেখে বলি, কী হলো? ও উত্তর দেয়, জেনি কাল রাতে মারা গেছে। আমি দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখি—বিছানায়। দেখেই মনে হলো ওর প্রাণ নেই। আমি অফিসে ফোন করতেই তারা বলেন, ওনাকে টাচ করবে না। চুপ করে বসে থাকো। আন্ডারটেকার আসছে।
গতকাল জেনি বলেছিল কি জানো?
কী বলেছিল?
টিনা, এই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টের কি জানো? (ওর নাম নাজমুন সেহার বা দিঠি কোনোটাই তারা বলতে পারে না ঠিকমতো। নাজমুন সেহার বলে—নাক মুখ সা। আর দিঠি বলে—টিটি। তাই টিনা)
কী সব চাইতে কষ্টের? ও প্রশ্ন করে।
কষ্ট? ওয়েটিং টু ডাই। মৃত্যুর অপেক্ষা। টিনা কিছু বলতে পারেনি। ওর অনুমতি নেই সেই বৃদ্ধাকে একটু হাগ বা কিস করে। কিছু হলে বিপদে পড়তে পারে। জেনিকে আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। চার জন ছেলেমেয়ে অনেক ফুল আর রোলসরয়েসে শরীর সাজিয়ে জেনিকে কবর দিয়েছে। তারপর বাড়িটা মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করে চার জন ভাগ করে নিয়েছে। টিনা মন খারাপ করে ছিল দুই-এক দিন। কত জনকে দেখতে হয়! কী একটা পড়াশোনা করেছিল। এখন সে দেখছে বৃদ্ধাদের। পছন্দ বৃদ্ধা। বৃদ্ধ নয়। বললাম কেন? ও জানায়, বুড়োদের জীবনতৃষ্ণা প্রবল। হঠাৎ করে আমাকেই এক কাপ সুপেয় জল মনে করে। তাই! হোমে বুড়ো ও বুড়িতে বিয়ে হয়।
একজন আছে, যার নাম এলিজাবেথ। বেশ ভালো অবস্থা তার। মনে হয় কোনো এক সময় লর্ডের বউ ছিল। তেমনই ভাবসাব। দিঠি ছাড়াও আরো চার জন যায়। একেক জনের একেক কাজ। কেউ গোসল করায়। কেউ খাবার রেডি করে। কেউ ওষুধ খাওয়ায়। দিঠি বিকালের চা করে আর রাতের পোশাক পরতে সাহায্য করে। তারপর একটু গল্প করে। এলিজাবেথের পছন্দ দিঠি। একদিন না গেলে হেড অফিসে ফোন করে। বিশাল বাড়ি। একজন আছে বাড়িটা পরিষ্কার রাখে। এলিজাবেথ কোনো দিন হোমে যাবে না। নিজের বাড়িতেই মারা যাবে এমনিই ইচ্ছা। স্বামী অনেক দিন আগে মারা গেছে। বার্টি ডাইড লং টাইম এগো লাভ। হি ওয়াজ মাই চাইল্ডহুড সুইটহার্ট। মানে, এর আগে বা পরে আর কেউ নেই। বারান্দার গোলটেবিলে ওরা কখনো মুখোমুখি বসে গল্প করে। এলিজাবেথের বয়স ১০১। দাঁত, চোখ, চলা, বলা—সবই ঠিক আছে। তবে মাঝে মাঝে কানে একটু কম শোনে। হেয়ারিং এডটা পরতে চায় না। বলে, আরো নানা শব্দ বিরক্ত করে খুব। একটা গানের যন্ত্রে গান শোনে। এলিজাবেথ একসময় খুব ভালো গান করত। এখনো—কে সেরা সেরা বা তেমনি কিছু গুন গুন করে ভাঙা গলায়। ও ৪টায় যায়, সারে ৫টায় চলে আসে। দেড় ঘণ্টা এলিজাবেথকে সঙ্গ দেয়।
ও আরো কয়েক জনকে দেখে। একটা গাড়ি আছে ওর এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতে। যাদের গাড়ি নেই তাদের কষ্ট। বাসটাসে করে কোনোমতে কাজ করে। কাজেই গাড়ি থাকায় দিঠি বেশ সহজে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে পারে। একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে ওদের কাছাকাছি। মানে, যাদের ও দেখে তাদের কাছাকাছি।
একদিন এলিজাবেথ ওকে বলে, আমি একটু তোমার গাড়িতে দোকানে যাব। নিয়ে যাবে?
কেন? কী কিনবে?
এই নানা সব।