শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

হঠাৎ অগ্নিঝলক

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৫১

সকাল থেকেই আকাশ ঘনকালো মেঘে ঢেকেছিল। অন্ধকার ঘরে শুয়ে থেকেই সারা দিন পার করেছে তনশা। নিলুফা সকালে একবার এসে ডেকে গেছে। দুপুরে এসে অনেক মিনতি করল, আফা একটু হলেও খাইয়া লন।

বিকেল থেকে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। তনশা ব্যালকনিতে এসে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে বসে থাকে।

আরাফের সঙ্গে এমন অনেক বিকেল কাটিয়েছে তনশা। বৃষ্টি এলেই ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে এক কাপ দুধ-চা খাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তার। আরাফ বৃষ্টি এলেই ওর জন্য বানাত পাকোড়া। দুজনে কত গল্পই না করত! কত ভালোলাগার গল্প। কত গল্প মনে পড়ে। বর্ষার সময় একবার আরাফ তার এক খালার বাড়িতে বেড়াতে যায়। চারিদিকে পানি আর পানি। আরাফ ভয়ে বাড়ি থেকেই বের হতে চাইত না। একদিন তার খালাতো ভাই জোর করে নদীর তীরে নিয়ে গেল। সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে নদীতে সাঁতার কাটছিল। এত ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে সাঁতার কাটতে দেখে আরাফের মনে সাহস আসে। সেও নেমে পড়ে নদীতে। মুশকিল হয় তখন, যখন আরাফ পানি থেকে উঠে দেখে তার পরনের লুঙ্গি নদীতে ভেসে গেছে! ভাগ্যিস নিচে হাফপ্যান্ট ছিল। নইলে লজ্জার শেষ থাকত না।

শ্রাবণ মাস ছিল তাদের ভালোবাসার মাস। চার বছর আগে শ্রাবণ মাসেই তাদের প্রথম পরিচয়। তনশা বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে। একে তো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর বাস আসার কোনো নাম নেই। আশেপাশে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। বাস আসতেই ভিড়ের ভেতর ঠেলাঠেলি করে তনশা লাফ দিয়ে বাসে ওঠে। সামনে একটা ফাঁকা সিট দেখেই বসে পড়ে। তনশার এমন তড়িঘড়ি করে বসাতে, পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটির হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। তনশা সরি বলে ফোনটা তুলতে নিয়েছে তখন এক যাত্রীর ধাক্কায় তনশার ফোনটাও পড়ে যায়। এভাবে আরাফ আর তনশার ফোন পালটে যাওয়ার দরুন প্রথম পরিচয় হয় তাদের।

গত বছর শ্রাবণ মাসেই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে তারা। এমন বৃষ্টিময় রাতে ভালোবাসার চাদরে ডুব দিয়েছিল চাতক দুই পাখি। আরাফ যেন তনশাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ওদের ভালোবাসায় কার যে নজর লেগেছিল তনশা ভেবে কূলকিনারা পায় না। শ্রাবণের এক ঝমঝমে বৃষ্টির দিনে ভিজতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যায় আরাফ। আরাফকে হারিয়ে তনশা যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল। কথা বলে না, খাওয়াদাওয়া করে না। সব সময় দরজা-জানালা লাগিয়ে একা একা থাকে আর বৃষ্টি এলেই দৌড়ে ছাদে চলে যায়।

রাত নয়টা বাজে, তনশার ঘুম ভেঙে যায়। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। তনশা উঠে ঘরের ভেতর যায়। মোমবাতি জ্বালিয়ে আলমারি থেকে আরাফের পছন্দের মেরুন রঙের শাড়ি বের করে পরে। ঠোঁটে হালকা মেরুন লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে একপলক মোমবাতির আলোয় আয়নায় দেখে নেয়। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় ছাদে। আরাফ ছাদের যে স্থানে মরে পড়েছিল, সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

ভোর রাতে নিলুফা তনশার ঘরে এসে ওকে না পেয়ে তন্নতন্ন করে চারিদিকে খোঁজে। সব শেষ ছাদে গিয়ে দেখে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে তনশা। তনশার সেই যে জ্বর টানা এক সপ্তাহেও কমে না। তারপর সেই জ্বরের ঘোরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় তনশা। শ্রাবণের বৃষ্টির সঙ্গে ওদের জীবনে এসেছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। আর সেই শ্রাবণের বৃষ্টিতেই ভালোবাসার দুই পাখি চিরবিদায় নিল পৃথিবীর বুক থেকে।

[বগুড়া]

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন