এইডা আপনে কী কন? মাত্র তিনডা গরু আমাগো। হালচাষের লাইগা তো আরো গরু দরকার। হেই তিনডা গরু দিয়া একটা গরু জবাই করবেন?
ছফুরা রান্না করছে। পাশে তিন বছরের মেয়ে টিয়া ধুলোমাটি মাখামাখি করে খেলছে। চিন্তিত মুখে এসে ছফুরার পাশে গামছা বিছিয়ে বসে সাত্তার আলী।
হ, বলদটা জবাই দিমু।
ক্যা? কী অইচে?
দেহো টিয়ার মা, পনারো দিন হইলো—মানুষটারে মাইরা ফালাইলো, কেউ কিচ্ছু করলো না। একটা শোক মিছিল হইলো না। নেতারা সব পালাইয়া রইচে। আজব ঘটনা।
চুলোর আগুন উসকে দিতে দিতে তাকায় ছফুরা স্বামীর দিকে, নেতারা পলাইলে আপনে ক্যান সামনে আগাইতেছেন?
একটা মানুষ, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বুকের গভীর থেকে সাত্তার, হারা জীবন এই দ্যাশের মানুষের লাইগা জেল খাটলো, দ্যাশটারে স্বাধীন করলো, হেই মানুষটারে এমন কইরা মারলো হারামজাদারা—যহনই মনে পড়ে, টিয়ার মা, আমার বুকটা খামচে ধরে। আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আয়।
যাই কও, গরু জবাই দিতে দিমু না। ছফুরা সাফ জানিয়ে দেয়, আমাগো ঐ গরু কয়ডা ছাড়া কী আছে?
দুইডা গাই আছে না? দুই-তিন মাসের মইধ্যে বাচ্চা দিবো। আরো গরু হইবো তোমার। খুব অনুনয় করে সাত্তার আলী, আমারে বাধা দিয়ো না। অনেক ভাবছি, এই ছাড়া আমার উপায় নাই।
করো তোমার যা ইচ্ছা, শেষে বিপদে পড়লে আমারেই দোড়াদৌড়ি করতে অইবে, গলায় ঝাঁজ ছফুরার। আপনের বন্ধুরা কি আপনেরে ছাড়বে?
মাটির উপর নখ দিয়ে আঁচড় কাটে সাত্তার, সবই বুঝি। কিন্তু একটা কিছু না করলে আমার মন শান্ত হবে না। উজানগাঁওয়ের কয়জনের লগে আলাপ করছি, কেউ রাজি না।
হেরপরও আপনে গরু জবাই আর মিলাদ দেবেন?
আমি নেতার নামে এই কাজটা করুম টিয়ার মা। তোমারে তো কইলাম—পুরো বিষয়টা মনে পড়লে আমার বুকের মইধ্যে আগুন জ্বলে। অতোগুলা মানুষ—মাইয়া পোলা, পোলার বউ হকলকে মাইরা হালাইলো, দ্যাশের মানুষ কিছু করবে না? না করলে না করুক আমি করুম।
ছফুরা বুঝতে পারছে, মানুষটার মধ্যে নেতার জন্য মায়া ছটফট করছে। টিয়ার বাবা উজানগাঁও গ্রামের খুব সাধারণ মানুষ। কারো সাতেপাঁচে নাই। নিজের দুই বিঘা জমি আছে, পেয়েছে পিতার সূত্রে। সেই জমি চাষাবাদ আর গরু কয়ডা নিয়ে সাত্তারের দুনিয়া। রাজনীতি নিয়ে কখনো কারো সঙ্গে আলাপ করতেও দেখেনি। বছর দেড়েক আগে ভোট হয়েছিল, সেই ভোটও দেয়নি। সেদিন আরো সকালে উঠে গরু-লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে গেছে।
আপনে এত ব্যানে মাঠে যাইতেছেন ক্যান?
হাসে সাত্তার আলী, ভোটের হালারা আইয়া টানাটানি করবে। হের আগেই চাষে চইলা গেলে আর আমারে পাইবো না।
স্বামীর বুদ্ধিতে হাসে ছফুরা, আপনে ভোট দিতে না গেলেও মুই যামু।
যাও। আমার লাইন ধইরা খাড়াইয়া থাইকা রোদে পুইড়া ভোট দিতে ভালো লাগে না। হ হ হ... তুমি গেলে যাও, গরু দুটোকে সামলে নিয়ে হাঁটে, আমি গেলাম।
অবাক ছফুরা, সেই লোকটা মজিবারের লাইগা গরু জবাই দিয়ে মিলাদ পড়াতে চায়! মানুষ মারা গেলে তো মিলাদ দিতেই হয়। দুনিয়ার নিয়ম। বড় মানুষগো জন্য বড় আয়োজন। ছোট মানুষদের লাইগা ছোট আয়োজন। মজিবারের মতো বিরাট মানুষের জন্য আয়োজন হওয়া উচিত দ্যাশজুড়ে। কিন্তু এমন ঠান্ডা পরিবেশ দেখে মনের মধ্যে একটা ব্যথা চিনচিন করে ছফুরারও। কিন্তু সেই ব্যথা বা শোকের জন্য হালের গরু জবাই করে সাত্তারের মিলাদের আয়োজনটা ভালো লাগছে না। কিন্তু মানুষটার নির্দোষ মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগে ছফুরার। যা করার করুক নিজের মনে বললেও ভয় পায় ছফুরা, খাঁ বাড়ির জয়নাল খাঁ কি ছাড়বে? হেই বাড়ির সবাই মজিবারের বিরুদ্ধে ছিল। এখনো আছে। শুনেছে, মজিবারের মৃত্যুর পর হেরা উত্সব করেছে।
ত্বরিত্গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে সাত্তার আলীর সিদ্ধান্ত উজানগাঁও গ্রামে। খবর শুনে ছুটে আসে ছফুরার বড় ভাই গোলাম হোসেন, কী হোনলাম সাত্তার মিয়া?
কী হোনছেন আপনে?
তুমি নাকি গরু জবাই দিবা?
হ দিমু নেতার নামে।
এইসব পাগলামি করার পরামর্শ তোমারে কেডায় দিছে? মেজাজ গরম হয়ে যায় গোলাম হোসেনের, জীবিত মজিবারের লাইগা তো তোমারে কোনোদিন মিছিলে যাইতে দেখি নাই। মরার পর যখন দুনিয়া চুপ, কেউ কোথাও একটা কতা কইতেছে না, হেই সমায় এইসব পাগলামি ছাড়ান দাও।
আমি নেতার নামে মিলাদ দিমু। গোঁয়ারের গলা সাত্তার আলীর, গরুও জবাই দিমু। দেহি—কেডা কী করে আমার? সব হালায় বাউরা!
দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল উঠোনের পাশে, আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। ছফুরা গিয়েছিল পুকুরে পানি আনতে। কলসি ভরে পানি নিয়ে আসার পরে বড় ভাইকে দেখে এগিয়ে আসে, ভাইজান কহন আইছেন?
বোনের কথার জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে গোলাম হোসেন, তোর জামাই এইসব কী শুরু করেছে? এমনিতে দ্যাশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো ঠিকঠিকানা নাই, হেরে আইলাম পরামর্শ দিতে। উলটা আমারে কয় বাউরা?
বাম কাঁখ থেকে ভরা কলসি ডান কাঁখে চালান দিয়ে ছফুরা বলে, আমিও মানা করছিলাম ভাইজান। আমার কতা হোনে নাই।
থামা, এই সর্বনাশের কাম করতে না কর। একফির চিহ্নিত অইলে আর রেহাই থাকবে না। সরকার বা পুলিশ যদি জানে, তোর জামাইরে ধইরা জেলে নেবে, চাপা গলায় আসন্ন ঘোলাটে পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ করে গোলাম হোসেন। দ্যাশে কি নেতার অভাব পড়ছে? যারা মজিবারের দল করছে, লাফাইছে, আমদুধ খাইছে হেরা কই? তোর জামাই লাফাইতেছে ক্যান?
আমি জানি না ভাইজান। অনেক বুঝাইছি, হোনে না। তিনটা গরুর একটা জবাই দিয়া মিলাদ পড়াইয়া, মানুষরে মাংস খাওয়াই যদি হে শান্তি পায়, পাউক। আপনে ঘরে আসেন, দুফারে খাইয়া যাইবেন।
ছফুরার কথায় আরো জ্বলে ওঠে গোলাম হোসেন, তোর ঘরে এহন বসাও বিপদ। আমি যাইতেছি। যদি কোনো বিপদে পড়, আমারে ডাকবি না। হনহন করে চলে যায় গোলাম হোসেন।
তিনদিন পরে বাড়ির সামনে গরু জবাই করে সাত্তার আলী। উজানগাঁও গ্রামের গরুর কসাই হাজেন মিয়া গরু জবাই দিয়ে মাংস বানিয়ে দিতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে সাত্তারকে থানা শহর ভানডারিয়ার কসাই আজমতকে আনতে হয়েছে। আজমত যখন বাড়ির সামনের মাঠে গরু জবাই দিচ্ছে, জয়নাল খাঁর লোক জমির এসে বাধা দেয়, গরু জবাই দিয়েন না।
খুলে যাওয়া লুঙ্গি গিঁট দিতে দিতে আজমল তাকায় জমিরের দিকে, ভানডারিয়া যাইবা না? বেশি ঝামেলা করলে ভানডারিয়ায় তোগো পাইলে কাইটা পোনা গাঙ্গে হালামু।
জমির ভয় পেয়ে চলে যায়। দুপুরের মধ্যে গরু জবাই, কোটা ও রান্না শেষ। গরুর মাংসের সঙ্গে সাদা ভাত আর পাতলা ডাল। সাত্তার আলীর ধারণা ছিল শখানের মতো মানুষ আসবে। কিন্তু বেশিই আসে—এবং এই বেশি আসা মানুষেরা জোর করে হল্লা করে মাংস ও ভাত খেয়ে নেয়। এরা সবাই জয়নাল খাঁর মানুষ। কিচ্ছু করার ছিল না সাত্তারের।
মিলাদ ও খাওয়াদাওয়া শেষে মন খারাপ করে সাত্তার বাড়িতে যায়। ছফুরা সান্ত্বনা দেয়, আপনের গরুর মাংস অরা খাইছে, খাউক। মিলাদটা তো দিতে পারছেন!
কিন্তু আসল মানুষেরা খেতে পারেনি টিয়ার মা। ঐ হাভাতের গুষ্টি আইসা খাইয়া গেছে সব মাংস-ভাত-ডাল। মনে হয় কত বছর খায়নি।
মন খারাপ আর শেষ হয় না সাত্তারের। সারা দিন ঘরের মধ্যে শুয়ে-বসে থেকেছে। রাতে ঘুমুতে গেলে সারা দিনের কাজে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। মধ্যে রাতে দরজায় শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় সাত্তারের। দরজা খুলে বাইরে আসে। উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শালপ্রাংশু শেখ মুুজিব। হাতে পাইপ। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোট। ব্যাক ব্রাশ চুল। হাসছেন তিনি।
কী রে সাত্তার! তোর মন খারাপ ক্যান?
জানেন নেতা, আজ দুপারে...
পাইপ টানতে টানতে হাত তোলেন নেতা, শোন সাত্তার। মন খারাপ করিস না। আমার মৃত্যুর কারণে তোর আয়োজনে ঐ মানুষগুলো অনেকদিন পরে কয়েক টুকরো গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ পাইছে। আবার কবে মাংস খেতে পাইবে, ঠিক আছে?
নেতা!
হ, মন খারাপ করিস না। ভালো থাকিস...নেতা আর দাঁড়ান না। পাইপ টানতে টানতে স্নিগ্ধ জ্যোত্স্নার মধ্যে লম্বা পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছেন। সাত্তার আলী নির্বাক আনন্দের অতুলনীয় সুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই পবিত্র দৃশ্য দেখে, দেখে আর দেখে...। মানুষের পায়ের চিহ্ন এত টাটকা মজবুত আর সুন্দর হয়? সাত্তার আলী দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না।