কবিতা ছেলের হাতের মোয়া নয়। দু-চার লাইন কবিতা লিখলেই সহসা একজন কবি হয়ে ওঠেন না। ব্যক্তির সত্তা-তাত্ত্বিক অনুভূতির নির্যাস ও মৌহুর্তিক বয়ান কবিতা। আপাত সত্যের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে চিরায়ত সত্যের অনন্ত অভিযাত্রী কবি। মুহূর্তের ক্ষুদ্র অনুভূতিকে কবিতা মিলিয়ে দেয় অসীমের সঙ্গে। জীবনের এই বহমানতার রাজসাক্ষী হয়ে থাকে কবিতা। আর জীবন, কবিতা এবং বোধের অভিন্ন প্রতিবিম্ব হলেন কবি।
কবিতা সময়ের প্রয়োজনে রূপায়ণের নিগুঢ় দ্যুতি-খেলা খেলে অনুভবের বহুমাত্রিকতায়। অধরা অনুভূতিকে কবিতার শৈল্পিক অভিজ্ঞানে তুলে আনে মননের নিভৃত নির্জনতায়। কবি কবিতার ভেতর দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের প্রয়াস প্রগাঢ়ভাবে শব্দের প্রকৌশলে বিন্যাস করেন ভাষার কায়ায়, অপ্রমেয় ব্যাপ্তির অভিনবত্বের ইঙ্গিতে নিজস্ব ব্যঞ্জনায়। কবিতা সাহিত্যের আদিমতম একটি শাখা। কবিতা বা পদ্য ছাড়া পৃথিবীতে কোনো জাতি বা সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই, কখনো ছিল না। চতুর্দশ শতকে 'poesie' শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। লাতিন 'poetrica' থেকে ইংরেজিতে 'poetry' শব্দটির আবির্ভাব ঘটে। গ্রিক শব্দ হচ্ছে 'poiesis', যার ইংরেজি 'making', সে অর্থে কবিতাকে নির্মাণ হিসেবেও কেউ কেউ মনে করেন।
ধারণা করা হয়, যখন পৃথিবীর মানুষের কোনো অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তখনো মানুষের মুখে কবিতা ছিল। কবিতা নানা সময়ে নানা রূপে এসেছে। কবিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপগুলোই আজ কবিতার বিভিন্ন শাখায় পরিণত হয়েছে। এই কবিতা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বলা হয়, প্রায় সবার হৃদয়ে একটি কবি সত্তা বাস করে। মানুষ তার মনের ভেতরের যেকোনো ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো যখন ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে উঠে কবিতা। তবে এটি কবিতার কোনো সংজ্ঞা নয়। আজ পর্যন্ত কোনো কবি কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি। কবিতা নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত কবিগণ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজ নিজ ভাবনা প্রকাশ করেছেন মাত্র। সেই ভাবনা থেকেই আমরা কবিতার সংজ্ঞা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, 'Poetry is finer and philosophical than history; for poetry express the universal, and history only the particular (CHAPTER 9 OF THE POETICS)' অর্থাৎ, কবিতা ইতিহাসের চেয়ে সূক্ষ্ম ও দার্শনিক। কারণ কবিতা প্রকাশ করে সার্বজনীন আর ইতিহাস শুধু বিশেষ। এখানে তিনি কবিতার মাধ্যমে মানুষের সুগভীর ভাবনার প্রকাশ ও এর বিশালতার কথাই বলেছেন। কবিতা নিয়ে তার ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, কিন্তু কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচ্য নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি পার্সি বিশি শেলি কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, 'Poetry is the expression of imagination (A defence of poetry)' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে কল্পনার বহিঃপ্রকাশ। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবি মনের কল্পনার প্রকাশে পরিপূর্ণতা আসে। তার ভাষায় বোঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের বিষয়।
মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। শেলির এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই সহমত প্রকাশ করেছেন এবং এটি বেশ গ্রহণযোগ্য। তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে পরিপূর্ণ নয়।
নিজ নিজ ভাবনা থেকে কবিতা নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত কবিগণ নানাভাবে কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন কবি মেকল বলছেন, 'কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প, যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।' কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, 'Poetry is the performence in words' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে শব্দের ক্রিয়া।
কবি কোলরিজ বলেছেন, 'Poetry is the best words in the best order' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।
কবি এডগার এলান পো বলেছেন, 'I would define, in brief, the poetry of words as the rhythmical creation of beauty' অর্থাৎ, আমি সংক্ষেপে শব্দের কবিতাকে সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করব। কবি টি. এস. এলিয়ট বলেছেন, 'Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion: it is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things' অর্থাৎ, কবিতা আবেগের বাক হারানো নয়,কিন্তু আবেগ থেকে মুক্তি; এটি ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়, তবে অবশ্যই যাদের ব্যক্তিত্ব এবং আবেগ আছে তারাই অনুধাবন করতে সক্ষম এগুলো থেকে পালাতে চাওয়ার অর্থ কী?
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, 'Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotions recollected in tranquillity' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে শক্তিমান অনুভূতির অতি প্রবাহ, এটি প্রশান্তিতে স্মরণীয় আবেগ থেকে উৎসরিত। কবি কার্লাইল বলেছেন, 'Poetry is musical thought' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে সংগীতময় ভাবনা। কবিতা নিয়ে এই বিখ্যাত কবিদের ভাবনা খুব সুন্দর ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে কারও বক্তব্যই কবিতার চূড়ান্ত সংজ্ঞা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
কবিতা নিয়ে আরও দুজন বিদেশি বিখ্যাত কবি চমৎকার দুটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। কবি সেন্ট অগাস্টিন কবিতা সম্পর্কে তার ভাবনা থেকে বলেছেন, 'If not asked, I know. If asked, I don't know' অর্থাৎ, যদি জিজ্ঞেস না করা হয় আমি জানি। যদি জিজ্ঞেস করা হয় আমি জানিনা। এখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিতা কি, সেটা আমরা জানি। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। মনে হবে, কবিতা একটা রহস্যময়, অজানা কিছু, যা আমরা জানি না।
আর কবি জনসন বলেছেন, 'কবিতা হলো মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ ও সত্যকে মেলানোর শিল্প, যেখানে রিজনকে সাহায্য করার জন্যে ইমাজিনেশনের ডাক পড়ে।' এখানে তার বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কবিতা হচ্ছে এমনি এক শিল্প, যা দিয়ে আনন্দের সঙ্গে সত্যকে প্রকাশ করা হয়। আর সেটা প্রকাশ করার জন্য কল্পনার প্রয়োজন হয়। কবিতা বিষয়ক এই দুটি বক্তব্য থেকে কবিতার গভীরতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে স্পষ্ট নয়। অনেকেই আবার স্বীকার করেন, 'Poetry is imitation of life; Criticism of life; Mirror of life' অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে জীবনের অনুকরণ; জীবনের সমালোচনা; জীবনের দর্পণ। এটাও কবিতার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নয়, শুধু কবিতা সম্পর্কিত একটি ধারণা হিসেবে বিবেচ্য। কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়। কবিতা নিয়ে তিনি খুব সহজ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখানে তিনি কবিতাকে খুব সহজ করে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সংজ্ঞায় বোঝা যায়, কবিতা জটিল কিছু নয়। মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশ হলো কবিতা।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, 'কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের, সর্বোত্তম শব্দের, সর্বোত্তম প্রকাশ।' সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে। এই সংজ্ঞাটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত কবিদের দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে তার এই সংজ্ঞার কিছু মিল পাওয়া যায়।
কবিতার যথার্থ সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। আর্জেন্টিনার কবি লুইস বোর্গেস বলেছেন, 'কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। এটা অনেকটা রং, ভালোবাসা, হেমন্তে পাতা ঝরার সংজ্ঞা দেওয়ার মতো।' কবিতার রহস্য এখানেই। আর রহস্য থাকাতেই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, 'কোনো কবিকে এ ধরনের প্রশ্ন করা অনেকটা কোনো মহিলাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করার মতো। কবিতা সম্পর্কে বলতে গেলে ভিন্ন ভিন্ন কবির বিভিন্ন মতামত পাওয়া যাবে। একজন সুন্দর রমণীকে কবিতা হিসেবে বলতে পছন্দ করি।' অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ যা কিছু তাকেই আমরা কবিতা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি; গর্ববোধও করি। কবিতার এখানেই সার্থকতা, এখানেই শ্রেষ্ঠত্ব। কবিতার নির্মাতারা সে কারণেই সেরা হিসেবেই সর্বত্র বিবেচিত হন। কবিতার একটি পঙক্তির ব্যাখ্যা সহস্র পৃষ্ঠায় এমনকি অজস্র গ্রন্থেও অসম্পূর্ণ থাকতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, কবিতা নির্মাণের বিষয় নয়, আবিষ্কারের বিষয়ও নয়।
কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কবির জন্ম হয়। এ কথা যেকোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা না হলে ফরাসি কবি আর্তুর র্যাবো কিভাবে ২০ বছর বয়সের মধ্যে লিখে ফেললেন তার ভয়ংকর সুন্দর সব কবিতা, হুইটম্যান কেন ভবঘুরে জীবন যাপন করেও হয়ে ওঠেন মার্কিন কবিতার জনক, লেটোর দলের অন্যদের মতো হারিয়ে না গিয়ে নজরুল কিভাবে নাড়িয়ে দেন বাংলা কবিতার ভুবন। আর অসম্ভব প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যেখানে হতে পারতেন ভাইয়ের মতো আইসিএস অফিসার, তা না হয়ে, হয়ে উঠলেন বিশ্বকবি। কবির জন্ম না হলে এসব অসম্ভব, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এঁরা কেউ পাঠশালায় কবিতা শেখেননি ।
কিন্তু পড়েছেন প্রচুর, হৃদয়ে ও মননে ধারণ করেছেন কবিতা। পৃথিবীর ইতিহাসে সব কবি তাই জৈব-কবি। কবি বাল্মীকি থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম কবি পর্যন্ত। কবিতা শেখানো যায় না। তবে যা শেখানো যায় না সেটি শিখে নিতে হয়।
কবিতা পাঠে আনন্দ পাই। শুরু হয় আনন্দ দিয়ে। কবিতা পাঠ শেষ হলে একটি বার্তা পাই, তাতে আমরা প্রজ্ঞাবান হতে পারি। রবার্ট ফ্রস্টের মতে, 'Poetry begins in delight and ends in wisdom' অর্থাৎ, কবিতার শুরু হয় নির্মল আনন্দে এবং এর পরিসমাপ্তি হয় প্রজ্ঞায়। আমরা জানি, গাঁথুনি ও চিত্রকল্প মিলেই চমৎকার কাব্যশৈলী সৃষ্টি হয়। রচনার উৎকর্ষতার জন্য অলংকার প্রয়োগের যৌক্তিকতা অনেক বেশি। ভালো সাহিত্যের প্রধান গুণ হচ্ছে পাঠককে লেখকের কাছে নিয়ে যাওয়া। তাই তথাকথিত দুর্বোধ্যতা ছেড়ে খুব সাধারণ কথার ছন্দে কবিতা রচনা করলে পাঠকের মন জয় করা সম্ভব হবে। রচনার মহত্ত্ব ও ঐশ্বর্যমহিমা বা প্রভাবিত ক্ষমতা তৈরি করতে রূপকল্পনা কার্যকরী পদক্ষেপ। এটি একটি মানসিক ধারণা। আধুনিক কবিতায় রূপকল্প অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তাই কবিতায় কল্পনার পাখা জুড়ে দিতে হবে। কল্পনা যতদূর বিস্তৃত হবে; ততদূরই কবিতার সার্থকতা। মানব মনের বিচিত্র অনুভূতির ছন্দময় প্রকাশকে কবিতা বলা যায়। মানুষের অস্তিত্বের দুটি দিক- একটি দেহগত ও অন্যটি আত্মিক। অর্থাৎ একটি দৃশ্যমান অন্যটি অদৃশ্য- কবিতারও তেমনি দুটি দিক- একটি দৃশ্যমান, অন্যটি দৃষ্টির অগোচরে থাকে, মন বা অনুভূতি দিয়ে তা অনুভব করতে হয়। একটিকে বলা যায় কবিতার আত্মা, অন্যটিকে কবিতার শরীর। মনের ভাব ও অনুভূতিকে যদি কবিতার আত্মা বলি, তাহলে সেগুলোকে প্রকাশের জন্য যে শব্দরাজি ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে বলা যায় কবিতার শরীর। শব্দের নিপুণ বিন্যাসে ও আভরণে কবিতা বিচিত্র বৈভবে চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। তাই কবিতা পাঠে পাঠকের মনে আনন্দানুভূতির শিহরণ জাগে। এজন্যই হয়তো রোমান্টিক কবি জন কেটস বলেছিলেন, 'A thing of beauty is joy forever' অর্থাৎ, সৌন্দর্যমন্ডিত একটি বস্তু চিরায়ত আনন্দের।
একটি কবিতা যথার্থ কবিতা হওয়ার জন্য আরো কয়েকটি উপাদান বা অনুষঙ্গ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো- ছন্দ, শব্দালঙ্কার, রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্প ইত্যাদি। এ সবের সমন্বিত, সুসঙ্গত ও কুশলী ব্যবহারে কবিতা যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে। এ ধরনের কবিতা অনেক সময় এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে যে, তখন এগুলোকে অনায়াসে কবিতার শিল্প বলা যায়। তবে সব কবিতাই শিল্প নয়, কোনো কোনো কবিতা যথার্থ শিল্প হয়ে ওঠে। শিল্পী যেমন রঙ-তুলি ব্যবহার করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বর্ণময়, চিত্রময়, সৌন্দর্যময় বিচিত্র ভুবন নির্মাণ করেন, কবিও তেমনি শব্দের কারুকাজ করে কবিতার পুষ্পিত ভুবন তৈরি করেন। শব্দের কারুকাজে থাকে ছন্দের অনিন্দ্য ব্যবহার, রূপক-উপমা- রূপকল্পের মাধুর্যময় অতুলনীয় ব্যতিক্রমী আভরণ।
মনের ভাব একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এর সাথে কবির ব্যক্তি-জীবন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান ও অনুভূতির অবিভাজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। সর্বোপরি, মনের ভাব শরতের আকাশের মতোই ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। তাই কবিতায় কবি মনের যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ মুহূর্তের ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ। রোমান্টিক কবিদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অবশ্য কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়। তবে তা একান্তই দুর্লভ। ক্লাসিক অর্থাৎ ধ্রুপদ কবিদের প্রকাশ-বেদনার মধ্যে ব্যক্তি-অনুভূতির সাথে সামষ্টিক বা জাতিগত অনুভব-অনুভূতির প্রকাশ অনেকটা অনিবার্য। মহাকাব্য রচয়িতা বা মহাকবিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনুভূতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
কবিতার নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। যেকোনো বিষয়ই কবিতার উপজীব্য হতে পারে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয়, জাতিগত, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, দেশীয়-আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-ভালোবাসা, নৈসর্গিক বিষয় ইত্যাদি সবকিছুই কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে। অবশ্য তা প্রকাশের ক্ষেত্রে যথার্থ কবিতা পদবাচ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেকোনো বিষয় নিয়েই লেখা হোক না কেন, শিল্পের বিচারে যথার্থ কবিতা বিবেচিত হলেই কেবল তা কবিতা বলে গণ্য হয়। মনে রাখতে হবে যে, কবিতায় বিষয়ের চেয়ে ভাবের গুরুত্ব অধিক এবং তা ছন্দময়, লালিত্যময়, চিত্র-বর্ণে দীপ্তিমান নক্ষত্ররাজির মত স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
অগ্রসর কবিদের মতো এগিয়ে থাকা পাঠকরাও চান কবিতায় মনোরঞ্জক উপাদানের পাশাপাশি চিন্তা বা গভীর ভাব-কল্পনা থাকুক। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ইয়েটস, নেরুদা, আখমাতোভা, লারকিন প্রমুখ 'বড় কবি' হিসেবে নন্দিত হয়েছেন কেন? কারণ তাদের সমৃদ্ধ জীবনাভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সহজ কিন্তু গভীর এক একটি শৈলী যুক্ত হয়ে ফলিয়েছে নতুন শিল্প ফসল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তো সেই ১৭৯৮ সালেই কবিতায় সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। মাঝখানে দুশ' বছরের ভেতর অনেকেই সেই চেষ্টা করেছেনও। ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিজেও তার জীবদ্দশায় সাধ্যমতো সে কাজ করেছেন। রোমান্টিক যুগের অপরাপর কবিদের পাশাপাশি তার কবিতা পড়লে এই ভাষাজনিত তফাৎটি চোখে পড়ে। কবিদের অনেকেই বিশেষ করে তরুণ কবিরা, একটি কথা ভুলে যান। তা হচ্ছে- বিশ্বের তাবৎ প্রথম শ্রেণির কবিতা প্রথম শ্রেণির বিনোদনের জোগানদাতা। অনবদ্য কবিকল্পনা, ভাবপ্রকাশের বিশেষ নিজস্ব ধরন এগুলো তো থাকেই, তার সঙ্গে থাকে ওই শব্দের জাদু যা মজাদার হয়ে ওঠে শব্দের সঠিক প্রয়োগের গুণে। জীবনের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা অল্প-বিস্তর সবারই থাকে। কিন্তু একজন কবি জীবন সম্পর্কে সঞ্চিত যাবতীয় অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটান তার কবিতায়। তা যদি হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে, তাহলে কবির অভিজ্ঞতা ও ভাব কল্পনার অনেক কাছাকাছি পৌঁছে যায় পাঠকের অভিজ্ঞতা।
এসব কবিতা মানুষকে উদ্দীপ্ত হতে, দয়ায় আদ্র হতে, বিস্ময়ে অভিভূত হতে ও ভালোবাসতে শেখায়। কবিতা অসঙ্গতিভরা সমাজের বদল ঘটাবে, বিপ্লব আনবে এসব আবেগের কথা। তবে সমাজবাদী কবিতা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে পারে। সিকিপ্রেমিক বা আধাপ্রেমিক মানুষকে পুরোপুরি প্রেমিক বানাতে পারে। উন্নতমানের কবিতা অবশ্যই মানুষকে মূল্যবোধের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম। শেষ বিচারে কবিতা তো শিল্প। অন্যান্য শিল্পকলা যেমন রস অন্বেষী মানুষকে নির্মল ভালো লাগার অনুভূতি দেয় তেমনি কবিতাও রস উপভোগের মাধ্যমে পাঠক হৃদয়ে বেঁচে থাকার গভীরতর অর্থ জোগান দেয়। এভাবে একজন মানুষ, যিনি কাব্যানুরাগী, নিজেকে জীবনের অনেক তুচ্ছতা ও কালিঝুলির ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে শেখেন। কবিতার এর চেয়ে বড় উপযোগ আর কি থাকতে পারে?
বিখ্যাত কবিদের দেওয়া কবিতার সংজ্ঞা থেকে আমরা কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা খুঁজে বের করতে পারব না, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারব। কবিতা আসলেই বোঝার মতো খুব বেশি কিছু নেই, কবিতা শুধুই উপলব্ধি করার বিষয়। কবিতা উপলব্ধি করতে পারলেই কবিতার জন্ম দেওয়া যায়। কবিদের নানা সংজ্ঞা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, কবিতা অনেকটাই আসমানি কিতাবের ন্যায় ঈশ্বর প্রদত্ত দান। যাহা কবির মননে আসে এবং সুগভীর চিন্তা ভাবনার পর সুসজ্জিত ও অলংকৃত শব্দ বিন্যাস এবং কাব্যিক ছন্দ বিন্যস্ত কিছু বাক্যের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়। এটি অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব ধারণা, তবে এতে কারও ভিন্ন মত থাকতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক।
যারা কবিতা লেখেন, আমরা তাদের কবি বলি। আবার এটা নিয়েও বিতর্ক আছে, কারণ অনেকেই বলেন কবিতার মতন অন্ত্যমিলে কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না। তাই সবাইকে কবি বলা যাবে না। যারা কবিতা লিখেন, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হলেও কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেন না। এর কারণ হচ্ছে কবিতাকে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বেঁধে রাখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে কবিতা আমাদের সামনে এসেছে। ভবিষ্যতেও আরও নানা রূপে আমাদের সামনে আসবে। কবিতাকে কোনো নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়নি, যদিও কবিতা লেখায় অনেক নিয়মনীতি আছে। কবিতার বিভিন্ন রূপের জন্য বিভিন্ন নিয়মনীতি থাকবে, কিন্তু কবিতা থাকবে চিরকাল উন্মুক্ত। কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় কবিতাকে কখনো আবদ্ধ করা যাবে না। কবিতা মানুষের ভেতরের সত্তাকে অনুরণিত ও স্পন্দিত করে। কবিতা মানুষের কল্পনা শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।কবিতাকে সুরারোপ করলেই হয়ে ওঠে শ্রুতি মধুর সংগীত, যে সংগীত শুধু মানুষের চিত্তকে বিনোদিতই করে না, মানসিকভাবেও করে প্রশান্ত। কবিতার হৃদয় নিংড়ে সৃষ্ট সংগীত, মানুষের জীবনের নান্দনিকতার সুললিত স্পর্শ। সংগীতের মূর্ছনা ভালোবাসেন না এমন মানুষ সমগ্র পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কবিতা মানুষকে উজ্জীবিত করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাপিয়ে দিয়েছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্য হয়ে ওঠেন ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের আশ্রয়। জীবনানন্দ দাস হয়ে ওঠেন আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিবিম্ব। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই আমরা খুঁজে ফিরি আমাদের অর্থহীন জীবনের অব্যক্ত অর্থ।
'কবি' শব্দটিই বিদ্ৰোহবাচক, কারণ জীবনের ষড়যন্ত্রময় বস্তুসমূহের মারাত্মক অবস্থান যে মেনে নিতে অস্বীকার করে ও বেঁকে বসে সে-ই কবি”। একথা বলেছিলেন কবি শৈলেশ্বর ঘোষ। কবিতা তার কাছে চেতনার সম্প্রসারণ, আত্মার জাগরণ, নৈঃশব্দের উন্মাদনা, অভিজ্ঞতার সমষ্টি। প্রতিনিয়ত জীবন বাজি রেখে এক অনুসন্ধানমূলক যাত্রাই কবিতা। আর ক্ষমতার মূল্যবোধ থেকে মুক্ত রাখতে হবে কবিতার ভাষা। এই পৃথিবীতে জন্মেও যিনি নিজেকে ভিন গ্রহের বাসিন্দা মনে করেন। তাই তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লেখেন, 'যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে সরাব পৃথিবীর জঞ্জাল।' তাই এ পৃথিবীও তাকে আপন করে নিতে পারে না। তাকে মনে রাখে বিদ্রোহী হিসাবে। তিনি কবি। একজন কবি কবিতা লেখেন নিজেকে প্রকাশের উন্মাদনায়। যে উন্মাদনায় কবি হেলাল হাফিজ রচনা করেছিলেন কালজয়ী 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতাটির অমর পঙক্তি , 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়... '। কবি তখন মনে রাখেন না তাঁর লেখা ক'জন পড়বে বা ক'জন বুঝবে? যদি একটা কবিতা লেখার পর দেখে তাঁর লেখার কেউ প্রশংসা করছে না, বা তার পরিচিতি হচ্ছে না তাহলেও কবি কিন্তু তার লেখা বন্ধ করে দেন না। তাছাড়া এরূপ ভাবনা একজন কবির ভাবনা নয়। কারণ নিজেকে লেখে রাখাই কবির কাজ।
কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে তার নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। কোনটা আধুনিক, কোনটা উত্তরাধুনিক কিংবা হাংরিতাড়িত এসব নিয়ে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে কলাকৈবল্যবাদিগণ সহস্র মতবাদ ও মতাদর্শ উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু কবি শুধু তাঁর কবিতাটি লেখেন। লেখার বিষয়বস্তু তার রয়েছে বলে লেখেন। তিনি লিখতে পারেন, এ তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা, তাই লেখেন। সেই কবিতাকে কালসূত্রে রাঙিয়ে তোলেন প্রথমত পাঠক এবং দ্বিতীয়ত এইসব বোদ্ধাগণ, কবিতাকে যারা শ্রেণিভেদে অংকের সূত্রে ফেলে দিয়ে 'ইজম' বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করে থাকেন। তারা হয়তো একটা স্বীকৃতি প্রদানেরও চেষ্টা করে থাকেন। এতে নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন যে কবি , তিনি কি বিশেষ কোনও পথের দিশা পান? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে আমাদের মনে হতে পারে, এতে কবি অনুপ্রাণিত বোধ করতেই পারেন, আবার না-ও করতে পারেন। তাঁর কাজ তিনি করে যান শব্দ, উপমা এবং বাক্যের অনুবন্ধে। এখানে কবির আত্মা মূলত তারই সত্য উপলব্ধিকে ভাষা দান করে সেখানে প্রকৃতি-প্রাণের অমরত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকেন।
প্রখ্যাত কবি ও ক্রিটিক উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর মতে, 'Poetry is as immortal as the heart of man' অর্থাৎ, কবিতা মানুষের আত্মার মতোই অমর। আবার কবিতা লেখা বিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ মিলানোর চেয়েও কঠিনতম হয় কখনও, তবে কবিতায় যার দিনাতিপাত, তিনি শৈল্পিকভাবে নির্মাণ করেন এক একটি কবিতা। কবি তো কবিতায় অবগাহন করেন নিজের ভিতরে উদ্ভুত এক ঝর্ণাধারায়। ফলে, কবিতায় অবগাহন করতে গিয়ে কবি হয়ে ওঠেন সময়, জীবন ও প্রকৃতির এক ঐক্যতান।
পৃথিবীতে কবিদের প্রয়োজন কোনদিন ফুরাবে না। কবিরা মানুষের মনের কথা বলেন। আপন মনের কথা কবি মানুষকে জানান।একজন ভাবতেই পারেন, তার ভালোবাসার কথাটি তো রবীন্দ্রনাথই বলে গেছেন, খুবই সত্য, তবু নতুন সময়ে নতুন করে বলতে কারো ইচ্ছে হতেই পারে। কারণ আমরা নতুন দিনের নতুন মানুষ। আমাদের মনের কথা নতুন করে বলতে এখনও কম্পিউটার অক্ষম, সেটি বলতে সক্ষম একমাত্র কবিই। কীটস-এর একটি কথা আমাদের মনে আছে নিশ্চয়, 'Poetry of the earth is never dead' অর্থাৎ, পৃথিবীতে কখনই কবিতার দিন শেষ হবে না।কবিতার আঁচলের সুশীতল শ্যামল ছায়ায় আবৃত মানুষের জীবন। পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন সহ পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থই কাব্যিক ছন্দে রচিত। আমাদের শিক্ষার হাতে খড়ি হয় কবিতার মাধ্যমে। মানব জীবনের প্রতিটি পরতে এবং সভ্যতার স্তরে, স্তরে কবিতার পেলব ছোঁয়া অনস্বীকার্য। স্বপ্নে- সংগ্রামে, প্রেমে-দ্রোহে, শান্তিতে- যুদ্ধে, কবিতা আমাদের অনিবার্য সঙ্গী। তাইতো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কিংবা আব্রাহাম লিংকনের ঐতিহাসিক গেটিসবার্গের ভাষণ, সর্বত্রই কবিতার অনিন্দ্যসুন্দর অনুরণন ।
কবি কে ? কবিতো সেই মানুষই যিনি পরম সত্যকে অনুভব করতে পারেন এবং ভাষার আবেগ ও হিরন্ময় প্রভার সাহায্যে মানুষের হৃদয়ের গহনে পৌঁছে দিতে পারেন। অর্থাৎ কবিতা ও কবির সত্য মানুষ চিরকাল হৃদয় মেলে সাদরে গ্রহণ করেছেন। কবি সত্য প্রচারক, সর্বদা সমাজ সংস্কারক নন। কিন্তু সভ্যতার এই সূর্য সন্তানেরা বরাবরই অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। অতীতে সকল রাজদরবারেই একজন সভাকবি থাকতেন। রাজকোষ থেকে তাকে সম্মানী প্রদান করা
হতো।
অথচ বর্তমানে কবিদের, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের কবিদের অবস্থা সত্যিই করুণ। এই মহৎপ্রাণ কবিরা তিল তিল করে নিজেকে ক্ষয় করে দেশ ও জাতির স্বপ্নের মশালকে প্রজ্জ্বলিত করেন। কদাচিৎ আমরা আবহমান সভ্যতার ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক রূপ বিশিষ্ট লক্ষণ যুক্ত একজন কালোত্তীর্ণ কবি মনীষার সাক্ষাৎ পাই। মানুষের সভ্যতার অনন্য শ্রেষ্ঠতম অর্জন সমূহ এরা যেন অবলীলা ক্রমে আয়ত্ত করে নিজেদের কল্পনা প্রতিভার সাহায্যে মানুষের সামগ্রিক জীবনকে সার্থক করে তোলেন। স্বমহিমায় নিজেদের কাব্যে, সাহিত্যে, দার্শনিক বিবিধ রচনা ও উক্তির মাধ্যমে। এখানেই শেষ নয়, বর্তমান কাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক মানুষের দৃষ্টি জীবনের যে সব নিগূঢ় রহস্য ভেদ করতে পারেনি কিংবা সভ্য মানুষের বিকাশের পথে উত্তরণের সোপানে যে জ্যোতির্ময় জীবন দর্শন এখনো আয়ত্ত করতে পারেনি এইসব লোকত্তর কবি নিজেদের কল্পনা ও অন্তদৃষ্টির শক্তিতে সেই সুদূর ভবিষ্যতের অবয়ব আমাদের সম্মুখে অঙ্কন করেন। জার্মান কবি গ্যেটে এই ধরনের মহিমান্বিত কবি ছিলেন। আমাদের আধুনিক পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , কাজী নজরুল ইসলাম এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তও নিঃসন্দেহে এই রকমের লোকোত্তর কবি। কবি ভাষার শক্তি দিয়ে অদেখা সৌন্দর্যকে স্পষ্ট সুষমায় রূপান্তর করেন। একজন শিল্পীর মাহাত্ম্য সেখানেই। যেখানে সাধারণের ভাষা কিংবা সৌন্দর্য দেখার সুযোগ থাকে না সেখানেই সে নতুন পথের অনাদিকালের স্রষ্টা।
লেখক: ড.আব্দুল ওয়াদুদ, ফিকামলি তত্ত্বের জনক, শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য-বঙ্গবন্ধু পরিষদ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি।