সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনমান উন্নয়নে গত ১৬ বছর ধরে জাগো ফাউন্ডেশন কাজ করে চলেছে। এর আগেও আপনি বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। এবার র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারে ভূষিত হয়ে কেমন লাগছে?
পুরস্কার পেতে তো ভালোই লাগে। আমি কখোনো ভাবিনি এতো বড় একটা সম্মাননা আমি পেতে যাচ্ছি। কারণ সম্মাননা পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করিনি। র্যামন ম্যাগসেসে-তে কোনো নমিনেশন থাকে না। আমি নিজেও জানতাম না যে, গত ৫ বছর ধরে তারা আমার ও জাগো ফাউন্ডেশনের কাজ মনিটর করেছে। এর আগে দালাই লামা বা মাদার তেরেসার মতো মানুষ, আমাদের দেশ থেকে স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসরা এই অ্যাওয়ার্ডটা পেয়েছেন। সেই তালিকায় এবার আমার নাম এসেছে। যারা সবসময় আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং সাহস যুগিয়েছেন, আমি এটা তাঁদের উৎসর্গ করছি।
একটা স্বীকৃতি দায়িত্ববোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আপনার সামনের দিনগুলোর পরিকল্পনার কথা জানতে চাই।
র্যামন ম্যাগসেসে ভূষিত হওয়ায় আমি বলব যে আমার দায়িত্বও আগের থেকে আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। তবে আমার মনে হয় এই সম্মাননা আমার সামনের অনেক গুলো দরজা খুলে দেবে। যারা আগে আমাদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলতো তারা হয়তো এখন আমাদের পাশে দাঁড়াবে। দেশের জন্য, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য, তরুণদের জন্য কিছু করার আগ্রহ নিয়ে। এটা মামাদের জন্য আসলেও অনেক বড় উপকার হবে। আর আন্তর্জাতিক এমন অ্যাওয়ার্ড পেলে যারা আগে চিনতো না তাদের কাছে আমাদের পরিচয় দিতেও অনেক সহজ হবে। কারণ আমরা যে কাজ করে যাচ্ছি এই স্বীকৃতি গুলোই তার প্রমাণ। জাগো'র মডেলটা নিয়ে আমরা দেশের ভেতর কাজ করেছি। এখন একই মডেল নিয়ে আমরা দেশের বাইরেও কাজ করার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশের বহু তরুণদের আমরা সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে দেখি। এদের অনেকে ভালো কাজ করেন, আবার অনেকেরই ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে, বা লোকদেখানো কাজ করে। এই দিক থেকে জাগো ফাউন্ডেশনের কাজ ও কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে সম্পর্কে জানিতে চাই।
যেকোনো প্রতিষ্ঠান সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বচ্ছতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এই স্বচ্ছতার প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদেরকেও হতে হয়েছে। ২০১১ সালে আমাদেরও নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছিল। আমরা কিন্তু দমে যাইনি, থেমে যাইনি। সময়ের সাথে সাথে এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। যারা সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে আপনার সাথে কাজ করে, তারা যখন আপনার সাথে থাকবে তখন যেকোনো কিছু আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। আমাদের এখন ২৯টা পলিসি আছে, যেগুলো মেনেই আমরা কাজ করি। জাগোর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে জাগো’র ভলান্টিয়াররা। আর জাগোর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অর্থ-সহায়তার দিক থেকে বলতে গেলে যেকোনো দাতা সংস্থার প্রকল্পের একটা শেষ থাকে। কিন্তু শিশুদের যখন পড়াব, স্বপ্ন দেখাব, সবমিলিয়ে প্রায় ১৪ বছর লেগে যায়। সহায়তা শুরু করে কোনো দাতা যদি মাঝপথে চলে যায়, তখন বিপদে পড়তে হয়। তাই আমরা ব্যক্তিভিত্তিক দাতাদের সহায়তায় পড়াচ্ছি।
আপনার অনুপ্রেরণা কী?
যখন জাগো শুরু করলাম তখন শিশুরা রিকশাচালক হতে চাইত, কেউ বলতো সে ড্রাইভার হবে। সে এখন পাইলট হতে চায় বা উড়োজাহাজ বানাতে চায়। যে তরুণেরা একসময় হতাশায় থাকতো, সে এখন কোনো পুরস্কার জিতছে বা সফল হচ্ছে। এগুলোই আমাদের অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের জায়গা। পুরস্কার তো পায় আসলে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন। কিন্তু এর পেছনে আমার ৬০০ সহকর্মী, ৫০ হাজার তরুণ রাতদিন কাজ করছে।
১০ বছর আগে কি নিজের আজকের অবস্থান তৈরি হওয়ার কোনো পরিকল্পনা করেছিলেন? আপনার কাছে ‘সফল হওয়ার মন্ত্র’ কী, জানতে চাই।
আজকের এই অবস্থানে আসার জন্য যে এই কাজগুলা করবো আমরা এটাই জানতাম না। আমরা শুধু শিশুদের ইংরেজি শিক্ষা দিতে চেয়েছি। যেন ওদের জীবনটা সহজ হয়। খুব বেশিকিছু চিন্তা করে আমরা শুরু করিনি। আমাদের পুরো জিনিসটা হয়েছে এমনভাবে যে একটা করে সমস্যা এসেছে আর আমরা সমাধান করেছি। যেকারণে মনে হয় আমাদের কাজগুলা স্থায়ী হয়েছে। ২০০৭ সালে আমরা সুবিধাবঞ্চিত কিছু শিশুকে ইংরেজি শেখাব বলে কাজ শুরু করি। যখন শিশুরা বলল, স্যার আমাদের প্রমোশন কবে হবে, আমরা বুঝলাম যে, তাদের কল্পনায় এটা একটা স্কুল। শিশুরা আর অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদের এই উদ্যোগকেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো ভাবছে। এরপর মনে করলাম, কড়াইল বস্তিতে আরেকটা স্কুল করা দরকার। দুয়েক বছর যাওয়ার পর বুঝলাম যে ঢাকায় তো অনেকেই কাজ করছে, এর বাইরেও আসলে কাজ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ৫০ হাজার তরুণ বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা জেলায় যে তরুণরা আছে, তারা নিজেরাই নির্বাচন করে নেতৃত্ব ঠিক করে। নির্বাচিতরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোন লক্ষ্যটা তাদের জেলায় দরকার। এভাবে আমাদের যাত্রাটা অনেক বছর ধরে চলেছে। এখানে আসলে সফল হওয়ার মন্ত্র বলতে কিছু নেই। বলতে গেলে সমস্যা সমাধান করতে করতেই জাগো আজ এই জায়গায়। ছোট ছোট মিশনের সমস্যা সমাধান করতে করতে আপনি একসময় বড় জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন।