মহাকালের তুলনায় মানুষের আয়ু সীমা নিতান্তই সামান্য। এই সীমিত জীবন-পরিধিকে কিছু মানুষ আপন সৃষ্টি বৈভবে সমৃদ্ধ ও সার্থক করে তোলেন। তাদের যাপিত জীবন নিঃসন্দেহে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। এ হৃদয়সংবেদী মানুষগুলো ব্যক্তির অন্তঃপুরের অনুরণনকে, জীবনের অন্তর্ভেদী রূপকে বাণীতে বাঙ্ময় করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রগলভতা এড়িয়ে সংযত ও পরিশীলিত ভাষায় বাণীর অবয়বে নির্মাণ করতে সচেষ্ট হন অনুভূতিরঞ্জিত উপমা ও বাকপ্রতিমার শুভ্র মিনার।
ইতিহাস ও সমাজের স্থলন, বিচলন এবং পরিবর্তনকে উপলব্ধির প্রয়াস প্রগাঢ়ভাবে বিদ্যমান বাণীর শৈলীতে। জীবনের অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বাণীর মুখোমুখি দাঁড়ালে। বাণীর হৃৎপিণ্ডে কান রাখলে হাসি-কান্নার বিমূঢ়তা আর ধৈর্য অথবা হারানো বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার মতো অসংখ্য সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শব্দ শোনা যাবে, কিন্তু তাকে সুনির্দিষ্ট করে, তার অবয়বটা সুস্পষ্ট করে, তাকে অবধারিতভাবে মূর্ত করে সেরকম কোন শব্দ শোনা যাবে না।
বাণীর আছে নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি, বাণীর ভাষা সর্বদা স্বাদু-শিল্পিতায় মোড়ানো এমনটা বলা যাবে না ; কিন্তু বাণী অমনোহর, নিরাবরণ হলেও নিপাট স্পষ্ট।
বাণী সৃষ্টির জন্য রীতিনীতি, প্রথা, কৌশলগত দক্ষতা সকল কিছু আয়ত্তের সাথে সাথে বাণীর রচয়িতাকে তাঁর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের উপযুক্ত করে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই সে বাণী সক্ষম হবে সমাজে স্থায়ী ছাপ ফেলতে।
টানাপোড়েন বা দ্বান্দ্বিক বিরোধ বাণীতে সহজাত; বাস্তবের সুতীব্র অভিজ্ঞতা হতেই শুধু বাণীর উদ্ভব হয় না, এটি অবশ্যই বিনির্মিতও হয়, বিষয়গত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে রূপ লাভ করে। বাণী হচ্ছে ব্যক্তির সমগ্রের সাথে একীভূত হওয়ার অপরিহার্য উপায়। এটি তার সংঘবদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা ও ধারণা বিনিময়ের অসীম সামর্থকে প্রতিফলিত করে। বাণী শব্দের ইংরেজি অর্থ মেসেজ (Message)। বাণী ক্ষুদ্র হতে পারে, বাণী বড়ও হতে পারে। এক কথায়ও হতে পারে। বাণী সমাজকে বার্তা দেয়। কোন জাতীয় দিবসে ও অনুষ্ঠানে, গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে; রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাণী দেন। এর অর্থ-ঐ দিনটির ও ঐ অনুষ্ঠানটির গুরুত্ব সম্পর্কে সর্বসাধারণকে বার্তা প্রদান । বাণী জ্ঞানকে পরিশীলিত করে।
মানুষের মন ও মননের ওপর বাণীর প্রভাব অপরিসীম। শৈশবে আমাদের শিক্ষার হাতেখড়ি হয় আদর্শ লিপির বাণী পাঠের মাধ্যমে। কেউ বার বার একটি বাণী পাঠ করলে সেই ব্যক্তির মধ্যে বাণীটির প্রতিফলন ঘটে। বাণী মানুষকে চিন্তাশীল হতে শেখায় ও আত্মসংশোধনে উদ্বুদ্ধ করে। "সদা সত্য কথা বলিবে" ; "সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা" প্রভৃতি বাণী শ্রবণ করে ও পাঠ করে নৈতিকতার ভিত্তি প্রোথিত হয়েছিল আমাদের শিশু চিত্তে।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এবং সমাজ পরিবর্তনে বাণীর ভূমিকা অনবদ্য। কয়েক সহস্রাব্দ পূর্বে গ্রীক দর্শনিক মহামতি সক্রেটিসের "Know thyself" (নিজেকে জানো) বাণীটি তৎকালীন গ্রিসে মনস্তাত্ত্বিক জাগরণের সৃষ্টি করেছিল, যে জাগরণে ভীত হয়ে ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী দার্শনিক সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বাধ্য হয়েছিল। সক্রেটিসের সেই ধ্রুপদী বাণীটি আজ সমগ্র পৃথিবীর বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মের অম্লান কিংবদন্তী। সক্রেটিসের অন্য আরেকটি কালোত্তীর্ণ বাণী, "virtue is knowledge " (পুণ্য হল জ্ঞান) জ্ঞানের অম্লান মহিমার অনন্য উচ্চারণ। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূরীভূত করতে এই একটি বাণীই যথেষ্ট।
সক্রেটিসের সুযোগ্য উত্তরসূরী প্লেটোর অবিস্মরণীয় বাণী, "Necessity is the mother of invention" (প্রয়োজন আবিষ্কারের প্রসূতি) গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করবে চিরকাল। সমাজে সত্যবাদীদের অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করে প্লেটো বলেছিলেন, "No one is more hated than he who speaks the truth" (সত্যবাদীর চেয়ে বেশি ঘৃণিত কেউ হয় না)। একজন নির্যাতিত নিপীড়িত সত্যবাদীর জন্য সান্ত্বনা প্লেটোর এই বাণীটি।
দার্শনিক প্লেটোর অন্যতম ভাবশিষ্য অ্যারিস্টটলের "The hardest victory is the victory over self" (সর্বাপেক্ষা কঠিন বিজয় হলো নিজের উপর বিজয়) বাণীটি একজন মানুষের আত্মউন্নয়ন ও আত্মশুদ্ধির অন্যতম পাথেয়।
পৃথিবীর সকল ধর্ম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাণীর মাধ্যমে। আইয়ামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে পবিত্র আলোর মশাল রূপে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর হিরণ্ময় বাণী "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ " (আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই)। মহানবী (সাঃ) এর এই একটি বাণী জাজিরাতুল আরবে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিল তৌহিদী সমাজ। উন্মোচিত করেছিল সভ্যতার নতুন দিগন্ত।
শ্রীমদ্ভগবদ গীতার "কর্মণ্যেবাঁধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন (২/৪৭)" [কর্ম করাই তোমার অধিকার, ফলাফলে না, তাই তুমি কর্মফলের বাসনা রেখোনা এবং কর্ম ত্যাগ করার বিচার করো না ] বাণীটি মানুষের জীবন সংগ্রামের ও কর্মউদ্দীপনার চিরায়ত পাথেয়। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাণী "সকল ধর্মই সত্য , যত মত তত পথ" পরমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের অনন্য অনুপ্রেরণা।
গৌতম বুদ্ধের "সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্ত" (জগতের সব জীব সুখী হোক) একটি অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবীর আরাধ্য স্বপ্ন। আবার ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘর্ষকে সম্প্রীতিতে রূপান্তরিত করে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বাণী "Science without religion is lame, religion without Science is blind" (ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ)।
সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ কোন উক্তি বা ধ্রুপদী কোন উদ্ধৃতি বাণীতে রূপান্তরিত হয়; যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের Hamlet নাটকের " To be, or not to be, that is the question" (হবে কি হবে না? এটাই প্রশ্ন) লাইনটি মানুষের জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের দোলাচলকে ফুটিয়ে তোলে সুচারুরূপে। রোমান্টিক কবি জন কিটসের "Beauty is truth, truth beauty" (সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর)পঙক্তিটি সত্যের সঙ্গে সুন্দরের রাখি বন্ধন সৃষ্টি করে।
রবার্ট ব্রাউনিং এর The patriot কবিতার " Thus I entered, and thus I go" (এইভাবে আমার আগমন, এইভাবে আমার প্রস্থান) লাইনটি মানুষের ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক জীবনের প্রভূত অর্জনের অসাড়তাকেই প্রমাণ করে।
মানুষের একাকীত্ব ও অসহায়ত্বের অমোঘ বাণী হয়ে উচ্চারিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের "পৃথিবীতে কে কাহার" এই উদ্ধৃতিটি। মানবতাবাদের অমৃত বাণী হয়ে ওঠে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতার "মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই" পঙক্তিটি। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের "তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন?" উদ্ধৃতিটি শুভ বোধ জাগ্রত করে মানবিক হওয়ার অনন্য প্রয়াস।
একটি বাণী হতে পারে একটি বিপ্লবের অনুঘটক এমনকি একটি জাতির বা দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। সমগ্র ইউরোপের ইতিহাস পরিবর্তন করে দিয়েছিল ফরাসি বিপ্লব ১৭৮৯ সালে বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন ইউরোপের অভ্যুদয় হে বিপ্লবের স্লোগান ছিল Liberty, Equality and Fraternity (স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব) আর বিপ্লবের নেপথ্যের মন্ত্র ছিল দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোর কালজয়ী বাণী Man is born free, and everywhere he is in chains " (মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, এবং সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত)।
কার্ল মার্কস এর একটি বাণী সমগ্র পৃথিবীকে আন্দোলিত করেছে "Let the ruling classes tremble at a Communistic revolution. The Proletarians have nothing to lose but their chains. They have a world to win " (শাসক শ্রেণীগুলোকে কমিউনিস্ট বিপ্লবে কাঁপতে দিন। সর্বহারাদের তাদের শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই হারানোর নেই। তাদের জয় করার জন্য একটি দুনিয়া আছে)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের "I have nothing to offer but blood, toil, tears and sweat" (রক্ত, পরিশ্রম, অশ্রু আর ঘাম ব্যতীত আজ আমার আর কিছুই দেওয়ার নেই) বাণীটি ব্রিটিশদের ভীষণভাবে উজ্জীবিত করে বিশ্বযুদ্ধের পটপরিবর্তনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল। "Give me blood and I will give you freedom."
(আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব) নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের এই একটিমাত্র বাণী সমগ্র ভারতবর্ষে নবজাগরণের উন্মেষ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল; আজাদ হিন্দ ফৌজের মাঝে সৃষ্টি করেছিল এক ইস্পাত কঠিন প্রত্যয়।
আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর ঐতিহাসিক গেটিসবার্গের ভাষণে উচ্চারিত বাণী, "Democracy is the Government of the people, by the people and for the people " (গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য) আধুনিক গণতন্ত্রের রুপভাষ্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৭ই মার্চের ভাষণের "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম " বাণীটি সমগ্র বাঙালি জাতির শাশ্বত মুক্তির প্রবাদ বাক্য।
পৃথিবীতে স্বপ্নই মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি মিসাইল ম্যান এ পি জে আব্দুল কালামের বাণী "Dream is not that you see in sleep; dream is something that does not let you sleep " (স্বপ্ন সেটি নয় যা তুমি ঘুমিয়ে অবলোকন করো, স্বপ্ন সেটা যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না) নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে । মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন এর " Where there is no vision, there is no hope" (যেখানে কোন দূরদৃষ্টি নেই, সেখানে কোন আশা নেই) বাণীটি মানুষের আশা ও স্বপ্নকে আরো সুদূরপ্রসারী করে।
বাণী শুধুমাত্র বিখ্যাত ও বিশেষজ্ঞদের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। অজ্ঞাত, অখ্যাত সাধারণ মানুষও কখনো হয়ে ওঠেন অসাধারণ বাণীর স্রষ্টা। তাইতো প্রাচীন বাংলার খনার বচনের বাণী "সকাল শোয় সকাল ওঠে তার কড়ি না বৈদ্য লুটে" এর উত্তরসুরি হয় আধুনিক পাশ্চাত্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বাণী "Early to bed and early to rise
Makes a man healthy, wealthy and wise."
নিরক্ষর বাউল সম্রাট লালন সাইজী এর "সময় গেলে সাধন হবে না" এই বাণীটি সংসারের ধ্রুব সত্য।
বিভিন্ন মনীষীদের বাণী আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি বাণী পড়তে ভালোবাসি এবং চেষ্টা করি প্রতি রাতে নিদ্রার পূর্বে একটি বাণী লেখার। আমার প্রতিটি বাণীর সঙ্গে আমি একটি পাখির ছবি সংযুক্ত করি, কারণ একটি বাণী পাঠে পাঠক হঠাৎ করে উদ্বিগ্ন হতে পারেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকিরও আশঙ্কা রয়েছে। আমার দীর্ঘদিনের গবেষণায় প্রমাণিত পাখির ছবি বা পাখি দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের Autonomous nervous system স্বয়ংক্রিয় ভালোলাগার অনুভূতি জাগ্রত হয়। তাই বাণীর সঙ্গে সংযুক্ত পাখির ছবি পাঠককে মানসিকভাবে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাণীর আলোয় আলোকিত হোক আমাদের সবার জীবন।
ড. আব্দুল ওয়াদুদ, ফিকামলি তত্ত্বের জনক; লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; প্রেসিডিয়াম সদস্য-বঙ্গবন্ধু পরিষদ ; প্রধান পৃষ্ঠপোষক- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি।