সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের গুরুত্ব

আপডেট : ২৯ জুন ২০১৯, ২১:৫৮

ড. মিল্টন বিশ্বাস

৯জুন (২০১৯) এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ডে ২৮ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত সফরের সাফল্য বর্ণনা করার সময় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জুলাইয়ে যখন চীন সফরে যাবেন তখন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন। তিনি আরো জানান, ‘চীন ও ভারত দুটি দেশের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব এবং আমরা সেই বন্ধুত্ব রক্ষা করেই চলেছি।’ অর্থাত্ চীনা সরকারের আমন্ত্রণে ১ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সে দেশ সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু বিশেষ গুরুত্ব পাবে। এছাড়া বিদ্যুত্ খাতসহ বিভিন্ন খাতে দুই দেশের মধ্যে মোট আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে বলে বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। শেখ হাসিনা ২ ও ৩ জুলাই চীনের দালিয়ানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের অধিবেশনে যোগ দেবেন এবং বাংলাদেশ ও এশিয়ার সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরবেন। বেইজিংয়ে অবস্থানকালে চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। সেখানে যে আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে সেগুলো হলো—ঢাকা বিদ্যুত্ বিতরণ কোম্পানি এলাকায় বিদ্যুত্-ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও সমপ্রসারণে কাঠামো চুক্তি, ডিপিডিসি এলাকা প্রকল্পে বিদ্যুত্ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও সমপ্রসারণে সরকারি পর্যায়ে কনসেশনাল ঋণচুক্তি, ডিপিডিসি এলাকা প্রকল্পে বিদ্যুত্-ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও সম্প্রসারণে প্রেফারেনশিয়াল বায়ারস ঋণচুক্তি, পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণে কাঠামোচুক্তি, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা চুক্তি, বিনিয়োগ সহযোগিতা ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে এমওইউ, ব্রহ্মপুত্র/ইয়ালু ঝাংবো নদের পানিপ্রবাহ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন বিষয়ে এমওইউ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পর্যটন কর্মসূচির বিষয়ে এমওইউ।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর সহযোগিতা চাইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় সম্ভব না হলেও এবার যে সফর হচ্ছে তাতে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের বিপদ ও দুর্ভাবনার কথা সরাসরি চীনকে জানানোর সুযোগ পাবেন।

বাংলাদেশ চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী। কারণ প্রাচীন বাংলা পরিদর্শনে আসা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ কিংবা সিল্ক রুটের বণিকরা দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের এই বাংলা ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গভীর ছিল বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আর সেই সম্পর্ক স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামল থেকে এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছাবে বলে মনে করেন উভয় দেশের নেতারা। 

গত ১০ বছরে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ২০টিরও বেশি চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। ফলে ২০০৯ সাল থেকে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ও আমদানির উেস পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ বাণিজ্য খুবই ভারসাম্যহীন। বাংলাদেশ চীন থেকে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলারেরও কম। দুই দেশের বাণিজ্যে বড়ো ধরনের ভারসাম্যহীনতা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, সিরামিক এবং ডালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির মাধ্যমে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এপিটিএর অধীনে ২০১০ সালের জুলাই থেকে চীনে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৭০০ পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাকি সব রপ্তানিযোগ্য পণ্যও চীনের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে আশা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য সহযোগী দেশে পরিণত হয়েছে। আগেই বলেছি ২০০৯ সাল থেকেই চীন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বড়ো আমদানির উত্স। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চীনের ৪৯টি কোম্পানি বাংলাদেশের আটটি ইপিজেডে ৩০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া চীনের আরো ৩০০টি কোম্পানির ২৩০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ-প্রস্তাব বাংলাদেশের বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে রয়েছে। মূলত চীনের রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিদ্যুত্, অবকাঠামো নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, সার, বস্ত্র, চামড়া, সিরামিক এবং প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

২০১৪ সালের ১০ জুন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, চীনের কাছে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং তাঁর দেশ বাংলাদেশকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে। তিনি বলেন, কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক একটি কৌশলগত সম্পর্ক এবং এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় চীন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আসলে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এদেশে এসে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে যুক্ত করেছেন পারস্পরিক সহযোগিতার নানান ক্ষেত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আমি খুব খুশি; ছয় বছর পর বাংলাদেশের মতো একটা সুন্দর দেশ সফর করতে পেরেছি। চীন ও বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশী, ভালো বন্ধু এবং ভালো অংশীদার। ২০১৭ সাল হবে চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বছর। আমি মনে করি, এই সফর সামগ্রিকভাবে দুই দেশের অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরো বলেন, ‘সমুদ্র বিষয়ে ও সন্ত্রাস মোকাবিলা, যৌথভাবে বিসিআইএসএম-এফসি, অর্থনৈতিক করিডর ও যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একযোগে কাজ করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ঐতিহাসিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে। চীন বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে ও অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস ও সমর্থন নিয়ে কাজ করে যাবে।’ যদিও ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর কোনো সহযোগিতা বাংলাদেশ সরকার পায়নি, তবু কূটনৈতিক দিক থেকে আমরা হতাশ হইনি।

বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মিয়ানমার (বিআইসিএম) অর্থনৈতিক করিডর প্রতিষ্ঠায় চীনের প্রস্তাবের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে। একসময়ের জনপ্রিয় ‘সিল্ক রুট’ হিসেবে পরিচিত এই করিডরের ফলে নেপাল ও ভুটানসহ এ অঞ্চলের সব দেশের জনগণ লাভবান হবে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অসাধারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষা কোর্সে বিপুলসংখ্যক চীনা ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করেন। উভয় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ও চীনা ভাষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক বন্ধনের অন্যতম সারথি। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনার চীন সফরে সেই প্রত্যাশার কতটা উন্নয়ন ঘটে তা দেখার বিষয়। আমরা প্রত্যাশা করছি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে। চীন চাইলেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে পারে। কারণ নিজভূমি থেকে উদ্বাস্তু নিরীহ জনগণ দেশে ফিরে যাক, তা তারাও চায়। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করলে বাংলাদেশের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হবে চীনের; ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রও প্রসারিত হবে।

n লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন