প্রতিদিন যে হারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হচ্ছে, তাতে শুধু শঙ্কাই নয়, যুদ্ধংদেহি অবস্থা। কিন্তু সবার মধ্যেই কেন জানি উদাসীন ভাব। যে পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করছে, সেই পরিবার অস্থি-মজ্জায় অনুভব করছে বেদনা আর কষ্টের গভীরতা কতটুকু! এর লাগাম কীভাবে টানা যাবে? অন্যান্য দেশ কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে অভূতপূর্ব সফলতা পেয়েছে?
২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি ছিল, তা ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দারুণভাবে পুষিয়ে নিয়ে সফলভাবে ডেঙ্গুর লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের পরের অবস্থা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ এবং ভারতের জন্য স্বস্তির। ভারতে এর তীব্রতা দিনে দিনে কমতে কমতে এখন তা স্বস্তির মধ্যে চলে এসেছে। যে কলকাতাকে ঘিরে ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রাতে মশা, দিনে মাছি, এ নিয়ে কলকাতায় আছি’, এখন সেই কলকাতা শহর এডিস মশামুক্ত করে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানিকে জয় করেছে। কী করে? কলকাতা পৌরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ড এবং আমাদের ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন মিলে ৭৫ + ৫৪ = ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। এই ১৪৪টি ওয়ার্ড মাত্র একজন মুখ্য পতঙ্গবিদ, একজন সিনিয়র পতঙ্গবিদ, তিনজন সেন্ট্রাল ভেক্টর কন্ট্রোল অফিসার, ১৬টি সেন্ট্রাল রেপিড একশন টিম, ১৬টি বড় ভেক্টর কন্ট্রোল ইনচার্জ তাদের অধীনস্থ ১৪৪টি ওয়ার্ড ভেক্টর কন্ট্রোল ইনচার্জের সার্বক্ষণিক তদারকি ও কমিউনিটি এনগেজমেন্টের মাধ্যমে যেভাবে দ্রুতগতিতে এডিস মশার বিস্তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে ডেঙ্গু বিস্তার প্রতিরোধ করতে সফলভাবে সমর্থ হয়েছে, বাংলাদেশে এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ সত্যিই সফলতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে অতি অল্প সময় লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। এক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে আমাদের কার্যপরিধিতে কর্মপরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে একই পরিমাণ লোকবলেই এটা সম্ভব হবে, শুধু মানবসম্পদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রায়োগিক বিভাজন প্রয়োজন। প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচ-ছয় জন প্রশিক্ষিত ওয়ার্ড ভেক্টর দমন কর্মী, একজন চৌকশ ইনচার্জের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে ২৪ ঘণ্টা। প্রত্যেক কর্মী নিজ নিজ ওয়ার্ডের প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে আপ-টু-ডেট তথ্য সংগ্রহ এবং মশার প্রজননস্থল ধ্বংস নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি বাড়ির মালিককে এই কাজের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করবেন। এলাকার জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এ কাজে দক্ষতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
প্রতিটি সিটি করপোরেশনে যে ১০টি জোন আছে, সেখানে এক জন করে চৌকশ জোন ভেক্টর ইনচার্জ থাকবেন, যাদের কাজ হবে প্রত্যেক ওয়ার্ড ইনচার্জ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন কি না। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জোনে আরো একটি করে র্যাপিড অ্যাকশন টিম থাকবে, যাদের মূল কাজ হবে সেন্ট্রাল লেভেল ও ওয়ার্ড লেভেল থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনে একটি করে ডেঙ্গু বা ভেক্টর ডিটেকশন সেন্টার থাকতে হবে। একইভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে প্রাইমারি আরবান হেলথ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকবেন। সেখানে অবশ্যই অন্যান্য রোগেরও চিকিত্সা হবে। এই আরবান প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে আগত যে কোনো রোগীকে যদি ডেঙ্গু হিসেবে সন্দেহ হয়, সঙ্গে সঙ্গে তার ব্লাড সেম্পল নিয়ে নিকটবর্তী ডেঙ্গু ডিটেকশন সেন্টারে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু ডিটেকশন সেন্টারে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে সেই তথ্য রোগীর মোবাইল ফোন নম্বর, ডাক্তারের মোবাইল ফোন নম্বর এমআইএসএ এমনভাবে ডাটাবেস সেট করা থাকবে, যেন একটা ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে জোন ইনচার্জ, সেন্ট্রাল ভেক্টর কন্ট্রোল অফিসার, সিনিয়র কীটতত্ত্ববিদ ও মুখ্য কীটতত্ত্ববিদসহ সব কাউন্সিলর, মেয়র, ডিজি হেলথ, পরিচালক সিডিসি, স্বাস্থ্যসচিবের দপ্তরসহ সব স্থানে পৌঁছে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ্য কীটতত্ত্ববিদ তার অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশ প্রদান করবেন সেন্ট্রাল র্যাপিড অ্যাকশন টিম ঐ নির্দিষ্ট জোনে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে রোগীর বাড়ির চারপাশে কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস এবং অ্যাডাল্ট মশা ধ্বংস করার জন্য যুক্তিযুক্ত অ্যাডাল্টিসাইডের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন। একইভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে যতগুলো হসপিটাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নার্সিং হোম, ক্লিনিক আছে, তার প্রতিটিতে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক ঠিক করতে হবে, যার প্রকৃত দায়িত্ব হবে যখনই কোনো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হবে, সঙ্গে সঙ্গে তার ঠিকানাসহ সব তথ্য এমআইএসের ঐ ডাটাবেসে প্রদান করবে। তার ওপর ভিত্তি করে ওপরের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ভেক্টর কন্ট্রোল ইনচার্জ প্রতি সপ্তাহে মশক নিধন সপ্তাহ পালন করতে পারলে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সহজ হবে। এইভাবে কলকাতা মডেল অনুযায়ী যথাযথ তদারকি ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে আমরা অবশ্যই সফল হব।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)