দক্ষিণাঞ্চলে গাছিদের সহজ পরিচয় ‘শিবলি’। নতুন নামটা এখনো তেমন চোখ সওয়া হয়ে ওঠেনি। ভরবছর কাজ থাকে না, পৌষে কুয়াশা মেখে গাছগুলো রসবতী হলেই কেবল ঠুঙ্গি কোমরে ঝুলিয়ে গাছিরা মাঠে মাঠে বেরিয়ে পড়ে। দড়া বেঁধে গাছে চড়ে, ডাল-কাঁটা কেটেকুটে সাফ-সাফাই করে নেয়। তারপর রসের ভাবগতি জেনে চাঁছার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তারা। দেহ পুরোপুরি রসে ভরে উঠলে আর বিরাম থাকে না। ফিনফিনে কুয়াশা মাথায় করে রামনগরের পথে তাই বেরুতে হলো। সুদূরের রামনগরে যাওয়া সহজকথা নয়। দু’পাশ থেকে উজাড় করা গাছগাছালি, লম্বা ধানমাঠ, সাদাজলে নীল জলেশ্বরীর বয়ান শুনতে শুনতে আমরা ছুটতে থাকি দক্ষিণে। রেওয়াজ করে দেখা দিচ্ছে পাথারিখেজুর। এত গাছ কেউ দরদ করে লাগায়নি। এমনি এমনি হয়েছে। জলাভূমি ছেড়ে ধানখেত, তারপর জলাভূমি, ফের ধানখেত লাফ দিয়ে দিয়ে থিতু হয়েছে জঙ্গলের পায়ের তলায়—ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে আসে গুটিধরা গ্রাম। জমি-জলের ক্ষণেক বিরতিতে নেমে এসেছে সাদা রঙের বকগুলো। পিচ, ইট বিছানো পথ, কোথাওবা পুরোটাই কাদা। খানাখন্দকের জবরদস্ত হাঙ্গামা আর রোদছায়ার ঝিলিমিলির মধ্যে উড়ে যাচ্ছে মোটরসাইকেল। সঙ্গে কলারোয়ার লাভলু এসেছে। শহর বেরিয়ে ফিংড়ি। তারপর ঢুকে যেতে হলো ব্যাংদহ ইউনিয়নে। গাঁওয়ালি পথ। লাভলু নিজেই ড্রাইভ করছে। একটানা চলে বুধহাটা বাজারে গিয়ে জিরিয়ে নিই। তারপর চা সিগারেট খেয়ে ফের দক্ষিণে। দরগাপুরের মুখেই খোলাপাথার। বাড়িভিটে, রাস্তা, মাঠ—সবখানেই খেজুর। কোথাও আবার এতোই গাছ যে মনে হলো সৌদি আরবের কোনো জায়গায় এসে গেছি। দরগাপুর হাই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। তারপর পথিকের কাছে ঠিকানা মেনে বামের সরু রাস্তায় নেমে যাই। ক্রমেই ফসলের আনুকূল্য। গেরুয়া আবাদ চিরে মেঠোপথ এঁকেবেঁকে একসময় পিচে ধরেছে।
হাত পঞ্চাশেক পর আরো একটা রাস্তা ত্রিমোহনা করেছে। গোটাকয়েক ঝুপড়ি মতোন দোকান। সার বেঁধে লোকজন দোকানে রাখা টেলিভিশনে সিনেমা দেখছে। করিম গাছির ছেলে আশরাফুলকে বাজারেই পাওয়া গেল। ভ্যান চালায়। মোটরসাইকেল ফেলে আমরা খোলা ভ্যানে উঠে পড়ি। আঁড়াজঙ্গল আর কাঁচাপথ পেরিয়ে পুকুরপাড়। নামতে বলাতে হাফ ছাড়ি—‘আমরা তাহলে এসে গেছি, নাকি?’ আশরাফ হাসিমুখে আঙুল উঁচিয়ে পাথারি বাড়িটা দেখায়। ধানকাটা মাঠে হেঁটে হেঁটে আমরা বাড়ির উঠোনে যাই। ছয়-সাত ঘর মানুষ নিয়ে দ্বীপ মতোন ফ্যালনাপাড়া। উঠোনকে আলাদা করে ভাবা যাচ্ছে না বরং পুকুরের সমান্তরালে এক ফালি গলি মতোন জায়গাটাই এদের কমন উঠোন। আশরাফ দুটো কাঠের চেয়ার ডাবগাছের তলে এনে পেতে দিলে আমরা বসে পড়ি। মিনিটের মধ্যে পাড়ার সবগুলো বাচ্চা আমাদের চারপাশে জড়ো হয়ে গেল। এরা ভীতুমুখে চুপচাপ ভদ্রভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। করিমের একটাই ঘর। করিমের স্ত্রী বিলকিস ছাপড়াতলে চুলায় ভাত চড়িয়েছে। হেঁসেলে জ্বালানি ঠেলে দিয়ে কোমরে শাড়ি গুঁজতে গিয়ে লাজুকমুখে জবাব দেয়, ‘উনিয়ে তো হোসেনপুরে বাঁশ কাটতি গ্যাছে।’ ছোট জা ফাতেমা কথা কেড়ে নেয়—‘আফনেরা বসেন, অখনি আইসে পড়বি।’
কোন ফাঁকে আশরাফুল দা হাতে কোনাকুনি পা ফেলে কায়দামতো পাশের ডাবগাছটায় উঠে যায় এবং প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গোটাতিনেক ডাব হাতে নেমে আসে। তারপর ডাবগুলোর মুখ কেটে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ন্যান’। মোঙ্গার বাজারে একটা ভ্যানওয়ালা এভাবে আপ্যায়ন করতে পারে ভাবাই যায় না। আমরা পরস্পর মুখে মুখ রাখি কিন্তু ধন্যবাদ দেই না বরং টাটকা টলটলে পানি ডাব উপুড় করে গেলাসে ঢালি। তারপর ঢকঢক করে খেয়ে আরামের আহ্ শব্দ করে ফের দিগ্বিদিকে চেয়ে দেখি। শরিফুল এক কোপে কাঁচা ডাব দুটো দুই ফালা করে আমাদের মুখের সামনে তুলে ধরে। হ্যাবলা হয়ে প্রশ্ন করি, কর কী! শরিফুল দাঁত বের করে হেসে ওঠে, তারপর বলে,—‘কোমলা শাঁস; আফনারা খাবেন তাই।’ কিছু বলার থাকে না। অন্যমনস্কের মতো ইতিউতি চোখ ঘোরাতে গিয়ে দৃশ্যটা আটকে যায়। লাগোয়া পুকুর থেকে দু’ঘর বাদের এক মহিলা গোসল সেরে ভেজা শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে দ্রুত হরিণের মতো পা ফেলে লাউয়ের মাচার তলে চলে যায়। অগত্যা আমরা সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে আনি। কিন্তু দৃশ্যটা মাথার ভিতর বেশ খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে। তারপর একসময় ছবিগুলো হাবিজাবি রেখাময় হয়ে মিলে গেলে রোদেল মাঠে লম্বা পা ফেলে দোহারা করিম ফিরে আসে। জওয়ান মানুষ। গতর খেটে খেটে তাঁর পেশিগুলো কামারদের মতো গোটা গোটা হয়ে গেছে। নতুন করে কথা জমতে শুরু করে।
ইতিমধ্যে হোসেনপুরের আজাহারুল, আবদুর রহমানসহ পার্শ্ববর্তী গাছিরা হাজির হয়ে যায়। গল্পগুলো শেষ হতে চায় না বরং ডালে ডালে ছড়িয়ে যেতে থাকে। একসময় আলাপ-সালাপের মধ্যে মেয়েছেলেরাও কথা তোলে। ক্রমেই ভিড় বাড়ে। গাছ বাইতে বাইতে করিমের একটা ঠিকানা হয়ে গেছে। গাছে হাত দিলেই সে রসের ভাবগতি বুঝতে পারে। রস পুরা হলে প্রথমে কাঁটাওয়ালা ডালপালাগুলো কেটে চাঙড় তুলতে হয়। এ হলো ‘গাছতোলা’। চার-পাঁচ দিন বাদে চাঁছ দিয়ে ডিজাইন মতো কোনাকুনি কাটিং করে দিন কয়েক সুকান দেওয়া লাগে। একে বলে ‘হিরকাটা’। ‘হিরকাটা’র চার-পাঁচ দিন পর ফুল চাঁছ দিলে কাঁটাপথ ধরে রস নামতে শুরু করে। রসকে একপথে আনতে নলিন-খিলিন করতে হয়। মানে আগারি কঞ্চি ফেড়ে ফালির চোখা মাথা ড্রেনকাটা পয়েন্টে ঠুকে ঠুকে মারতে হয়। এবারে দু-পাশে খিলান পুঁতে ভাড়া ঝুলিয়ে দিলেই হয়ে গেল। গাছতোলা, হিরকাটা এবং ফুল চাঁছের জন্য আলাদা রকমের দা লাগে। দা’য়ের বর্ণনার ফাঁকে বিলকিস কথা বলে ওঠে—‘উ লোকের বছরে চার-পাঁচ খান দা লাগে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি সে গাছ কাইট্যে। উ তো একলাই বিশ গন্ডা করে গাছ কাটে। উ আবার বেশি ছাড়া কম কাটতি পারে না।’ স্বামীর এহেন তাকতের বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর মুখে লজ্জা এবং গর্ব একসঙ্গে মিশেল হতে থাকে। আমরা সেদিকে খেয়াল করতে চাই না, বরং অন্যকথা তুলি। খেজুরের গল্পের সঙ্গে যোগ হয় বিলকিসের পারিবারিক বিষয়আশয়। প্রথম স্ত্রী বছর বিশেক আগে মারা যাওয়ার পর কলারোয়ার বিলকিসকে বিয়ে করে এনেছিল করিম। আগের স্ত্রীর বিষয়ে বিলকিসের আলাদা কোনো বিকার নেই বরং তাঁর শরীরের বাঁধন বেশ মোটা। মামুলি বিষয় তাঁকে কোনোদিনই ভাবিয়ে তোলেনি। আশরাফুল আগের স্ত্রীর দিককার হলেও বিলকিস নিজের সন্তানের মতোই দেখভাল করে তাকে। এরকম একটা গরিবি অথচ সুখী পরিবারের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে একসময় আমরা রসের গুণাগুণ নিয়ে কথা তুলি। চাঁছা গাছে দু’দিন রস সংগ্রহ করে তিনদিন লাগাতার সুকান দিতে হয়। তারপর পুনরায় হেসুয়ায় চেঁছে জমানো রস দুই দিনে নামাতে হয়। পয়লা রাতের রসের নাম ‘জিরান রস’। পরের দিন-রাতের রস হলো ‘ওলা রস’। ওলা রসটা জিরানের মতো অত সুস্বাদু নয় বরং ঘোলা ঘোলা এবং খানেক হালকা কিসিমের। জিরান রসের কোয়ালিটি সবদিক থেকে ভালো বলে এ রসে সুমিষ্ট পাটালি তৈরি করা যায়, অন্যদিকে ওলা রস জ্বালালে পাটালির মতো অত জমানো যায় না, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। ওলা থেকে বড়জোর ঝোলাগুড় হয়। কথার ফাঁকে করিমকে জিগ্যেস করলাম, প্রতিদিন গাছ চাঁছা যায় না? এরকম প্রশ্ন শুনে করিম হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘শোনেন, রস নামানি বুজানিতে বেশ জ্ঞিয়ান (জ্ঞান) খাটানি লাগে। যেমন ধরেন প্রতিদিন যদি গাছ কাটি তালি পরে রস হলদে হয়ে সময়তি গ্যাজা উঠি যাপে। রস আর ভালো হবি না। আবার ধরেন, যদি আমি দ্বিতীয় দিন পর সুকানি না দিয়ে ফির ভাড়া দি তাহলিও টক রস বের হবি। তবে পুষের (পৌষ) মদ্যিখানে তিনদিনের দিনও রস নামানি যায়। ওগাকে নমঝড়া বলে। রস নামা-পাড়ার প্রত্যেক বারে বারে ভাড়া পালটানি লাগে।’
আলাপের মধ্যিখানে বিলকিস এসে পানি এবং পান দিলে করিম জর্দাভেজা পান মুখে দিতে দিতে আমাদের কাছে জেনে নেয় যে আমরাও পান খাব কি না। বিলকিস আবারো লজ্জা পেয়ে যায়, ‘আপনেরা ভাত খাইয়ে যাবান। খালি অ্যানা ডিম ভাজি করা লাগবি।’
বিলকিসের এহেন আবদারি শুনে হাসিমুখে বলি, আবার একদিন আসব তখন খেয়ে যাব। বিলকিসের যেন বিশ্বাস হতে চায় না। সে আগের মতো লজ্জা-মুখে আমাদের মুখ পানে চেয়ে থাকে।