শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গল্প

নাইওর

আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৫

বছরের এই একবার নবান্ন পর্বে আশুরা বিবি বাপ-ভাইয়ের বাড়িতে যায়। গত চল্লিশ বছরে এর অন্যথা হয়নি। বাপের বাড়ি যাবার আগে তার সাজগোজ দেখার মতো একটা বিষয়। মাথায় তেল দিয়ে চুল টান করে বড় বউমাকে দিয়ে খোঁপা বেঁধে নেবে। একটা চুলও যেন এদিক-ওদিক বের হয়ে না থাকে সেদিকে কড়া নজর রাখার জন্য হাতে একটা আয়না নিয়ে বসবে। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বউমাকে বলবে, বুঝলি বউ, আতেলা মাথায় কখনো কারো বাড়ি যাবি না, বাপের বাড়ি তো কখনো না। গেলে তারা ভাববে, মেয়ে কষ্টে থাকে। জামাই মাথার তেলডাও মনে হয় কিনে দেয় না। বাপ-ভাইয়েরা বাড়ির মেয়ের কষ্টে বড় কষ্ট পায়। তাছাড়া তাতে সোয়ামির সম্মানও কমে। মেয়েমানুষের সব দিকে নজর রাখতে হয় রে মা। নে ওঠ বউ, এক চুল বাঁধতে গিয়ে সারা দিন লাগালে হবে? যা মমিনরে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরিয়ে দে। এতদূর যাব, তাড়াতাড়ি বের হতে হবে তো!

চুল বেঁধে উঠে, লাল পেড়ে কচি কলাপাতা রঙের পাট ভাঙা শাড়ি পরবে। আর মুখে দেবে সুগন্ধি মসলা এবং বেশি করে খয়ের দেওয়া পান। এই পানের রসেই ঠোঁট হয়ে যাবে টকটকে লাল।

লাল ঠোঁটে মধ্যবয়সি টুকটুকে ফরসা মানুষটা হয়ে ওঠে টিয়াপক্ষী। তার স্বামী অবশ্য তাকে ‘টিয়াপক্ষী’ বলেই ডাকে। এটা নিয়ে বউমারা আড়ালে হাসাহাসি করে। লজ্জা লাগে, আবার ভালোও লাগে। সেই বারো বছর বয়সে মা হারা আশুরাকে বাড়ির বউ করে এনেছিল দূর সম্পর্কের খালা। এই খালা, শাশুড়ি হয়ে মায়ের অভাব পূরণ করেছে।

শাশুড়ি মারা গেছে বছর দশেক হলো। কিন্তু মায়াটা তার মধ্যে রেখে গেছে। এর মধ্যে আশুরা বিবিও শাশুড়ি হয়েছে। তিন ছেলের বউ, দুই মেয়ে-জামাই আছে। এরা সবাই শাশুড়িকে পছন্দ করে। মানুষটা অকারণ খিটিমিটি করে পরের মেয়েকে কষ্ট দেওয়া কিংবা মেয়ের সংসারে ঢুকে কূটকচালি করা থেকে মুক্ত। চেহারায়ও ভালোমানুষিটা ফুটে ওঠে।

একদম তৈরি হয়ে ছোট ছেলে এবং বড় ছেলের ঘরের নাতিটাকে নিয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য যখন বাড়ি থেকে বাইরে বের হয়, তখন বাড়ির সবার মনটা বিষণ্ন হয়। বউরা বারবার বলে, মা বেশিদিন থাইকো না কলাম। বাপের বাড়ি গেলে তো আমাদের ভুলে যাও।

মেজো ছেলে তো বলতেই থাকে, এই বয়সে আবার এত নাইওর যাবার কী দরকার মা? মামা না গত সপ্তাহে তোমাকে দেখে গেল! তুমি বল তো, নানাকে সাইকেলে করে নিয়ে আসি।

ছোট ছেলের মাথায় টুকটাক জিনিসের পোঁটলাটা তুলে দিয়ে, নিজে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে নামতে নামতে বলে, ওরে পাগল বাপ-ভাইয়ের বাড়ি যে আমারও যাইতে মন চায়। তোরা বড় হয়েছিস, বউ আছে, তোদের বাপজান থাকছে, মন খারাপ করিস না। আমি আজ শুক্কুরবার তো, আগামী শুক্কুরবার চলে আসব।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি বউদের কাছে খাবার চেয়ে খেয়ো কলাম। বউরা আমার মেয়ের অধিক, তাদের কাছে লজ্জা কী!

ছামাদ মণ্ডল আস্তে করে বলে, বউরা ভালো আমি জানি। কিন্তুক তুমি না থাকলে বাড়ি বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। শুক্কুরবার পর্যন্ত থাকার কী দরকার; মঙ্গল-বুধবারে চলে আইসো।

আশুরা বিবি এবার রাগ দেখিয়ে বলে, হইছে হইছে, এবার পথ ছাড়ো সব। দুটো গ্রাম পর বাপের বাড়ি যাইছি। এই গাঙের ধার দি হেঁটে গেলে একটা ঘণ্টা সুমায় লাগে না। তার জন্য কত যাত্রাপালা করবে এরা। ও মালেক বাপ, মোমিন ভাই চল চল, দেরি হয়ে গেল।

আশুরা বিবি যাত্রাপালা বললেও নিজেও পালা করতে কম যায় না। খিড়কি দোরে দাঁড়িয়ে বলে, ও বড় বউ, তরকারিতে ঝাল কম দিস মা; এ বাড়ির সবাই ঝাল কম খায়। সেজো বউরে, নয়ন বকা দেয় না যেন দেখিস। ও ছেলের রাগ বেশি হয়েছে। বউয়ের সাথে মাস্তানি দেখায়। আমি এসে একদিন মাস্তানি ছুটানোর ব্যবস্থা করব। ছামাদ মিয়াকে বলে, নিয়ম করে খাবা কিন্তুক। তোমার কিন্তুক লো পেশার মনে রাইখো।

ছোট ছেলে এবার বিরক্ত হয়ে বলে, মা তাড়াতাড়ি চলো, পোঁটলা মাথায় করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাই...।

ছামাদ মণ্ডল তবু নদীর নাওঘাটা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। বর্ষাকালে নদীতে ইঞ্জিনের নৌকা চলে, স্থানীয়রা বলে ট্রলার। তখন বউঝিরা ট্রলারে করে বাপের বাড়ি নাইওর যায়। বছরের বাকি সময় গ্রামে হাঁটা ভরসা। গরুর গাড়িতে যাওয়া যায়। কিন্তু গাড়ির রাস্তা এতটা ঘুরপথ যে, আশুরা বিবির ভাষায়, তেপান্তর পাড়ি দিতে হয়।

ওরা তরতর করে হেঁটে চলে। শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে যায়। মামুদপুর পার হয়ে চরপাড়ার মাঠ। মাঠে কাজ করা কেউ কেউ জিগ্যেস করে, কোন গ্রামে যায়? উত্তর শুনে কেউ কেউ চিনতে পারে। আশুরা বিবিও অনেকের সঙ্গে কথা বলে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ফসল দেখে বলে, ‘এ বছর সরিষা মনে হয় ভালো হবে না ভাই? হিমডা কম আছে।’

আশুরা বিবি নেহাত গৃহবধূ না। বারো বছর বয়সে গরিব স্বামীর সংসারে গিয়ে দুজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসার এবং মাঠ-ঘাট সামলিয়েছে। বলতে গেলে তার বুদ্ধিতে বেশ সম্পন্ন গেরস্ত হয়ে উঠেছে তারা। ঘর-বাইর ভালো বোঝে।

নাতি মোমিনরে নদীর ভিতরে আঙুল ইশারা করে দেখায়, ঐ দেখ কত ট্যাংরা মাছ খেলা করে; আয় ধরি। ছেলে মিজান চিত্কার করে, এখন পানিতে নামবা না মা। মামুবাড়ি যাওয়ার সময় তুমি সবসময় এমন কর। এমন করলে আমি কলাম যাব না তোমার সাথে।

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছোট ছেলের শাসনে হাসে। আচ্ছা যা নামছি না। রোদ বাড়ছে, তাড়াতাড়ি পা চালা তোরা।

বেলা বারোটার আগে ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ির বউ-ঝিরা হইহই করে ছুটে আসে। পা ছুঁয়ে সালাম করে। ফুপু আপনে কলাম এবার মেলা দিন থাকবেন বলে আবদার করে। ভাইয়ের বউ এসে বউমা-মেয়েদের সঙ্গে সুর মেলায়। সত্যি বুবু এবার কিন্তু কডা দিন থাকবা। বাপজিও খুব আশু, আশু করছে। যাও দেখে আসো তারে।

বাপের বাড়িতে এসে যেন চপল কিশোরী হয়ে যায় সে। ছেলে, নাতির কথা এখন এরাই ভাববে। দ্রুত পায়ে বাবার ঘরের দিকে যায়। মানুষটার বয়স হয়েছে। চোখ দুটো সবার আগে গেছে। ভাই খুব যত্ন করে বাবার। বাপজি তেমন চলতে ফিরতে পারে না। ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে রেখে মা মরেছিল। আশুরা আর তার ভাইকে বুকে করে এই বাপ বড় করেছে। বিয়েটা পর্যন্ত করেনি। আগে সপ্তাহে একবার মেয়েকে দেখতে যেত। এখন আর পারে না। মেয়ে এসেছে দেখে খুশি আর ধরে না।

ক’টা দিন ভাইয়ের বাড়ির কর্তৃত্ব তার। সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সবকিছু কেমন নিমেষেই হয়ে যায়। ভাইবউটা শাশুড়ি হয়ে গেছে, তবুও ননদের সে আদরের ছোটভাইবউ।

এদিকে আপনজনের মধ্যে আনন্দের প্রহর কাটে। অন্যদিকে চিন্তা হয়, বাড়ির সবাই কী করছে? বউরা ছেলেমানুষ, সবকিছু কি আর বোঝে! মায়া এদিকে আটকে রাখতে চায়, অন্যদিকের মায়ার সঙ্গে দায়িত্ব এসে ইশারায় ডাকে। ফিরতে হবে।

আসছে বছর আবার আসব। ভালো থাইকো তোমরা। আমার বাড়ি যাবা সবাই। সংসার ফেলে কি আর থাকার জো আছে? আসার দিনের হাসিমুখে আজ কান্নার লোনা জল। তবু যেতেই হবে। সব প্রিয়জন নিয়ে একসঙ্গে হয় না আবাস। ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে যেতে হয়। আশুরা বিবি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। এই তো এতটুকু পথ, তবুও হয় না আসা। তাই বছরের ক’টা দিনের নাইওর থাক ভালোবাসা হয়ে। ভালোবাসা ছুঁয়ে।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন