বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

'মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবাসীরাও আস্থা রাখছেন লাইফস্প্রিংয়ে'

মানসিক সমস্যাকে অন্য আট-দশটি শারিরীক অসুখের মতো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় না। ফলে সমস্যাটি ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করতে শুরু করে, যা স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। মনের অসুখে ভোগা এমন অসংখ্য মানুষের বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছে লাইফস্প্রিং। আন্তরিকতার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে আস্থা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এখন তাদের সেবা নিচ্ছেন। লাইফস্প্রিংয়ের কার্যক্রম, পথচলা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া আমিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৬

ইত্তেফাক: আমরা দেখছি যে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা লাইফস্প্রিংয়ের ভিডিও কনটেন্টগুলো দেখেন এবং বিভিন্ন সেবা নিতে আপনাদের দ্বারস্থ হন। কিন্তু আমরা জানি, উন্নত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সেখানে অনেক ভালোমানের সেবা রয়েছে। তারপরও কেন প্রবাসীরা দেশের বাইরে বসে লাইফস্প্রিংয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন?

ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল: এর মূলত দুটো কারণ। প্রথমত, আমরা একটা ট্রাস্ট বিল্ডআপ করতে পেরেছি বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে, সেটা দেশে এবং বিদেশে। যারা একবার সার্ভিস নিয়েছে এবং তারা উপকৃত হয়েছে সেখান থেকে হয়তো তারা আরও ১০-২০ জনকে বলেছে।

দ্বিতীয়ত, আপনি হয়তো আমেরিকায় বসে আছেন, সেখানে সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্টরা অবশ্যই অনেক ভালো কাজ করেন। কিন্তু তারা হয়তো আমাদের দেশের কালচারটা বুঝতে পারছেন না। তারা আমাদের দেশের যে ফ্যামিলি অ্যাটমস্ফিয়ার আছে, সেখানকার যে কনফ্লিক্টগুলো সেটা কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না। তারা হয়তো ঔষুধ দিতে পারেন, কাউন্সেলিংয়ের যে সায়েন্টিফিক দিক সেটা তারা বোঝেন। কিন্তু আমাদের কালচারাল কনটেক্সট তারা বোঝেন না। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা কেবল আমাদের সঙ্গে কথা বলেই যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরা নন-জাজমেন্টালি তাদের ভ্যালু, ইথিকস, মোরালিটিসহ সবকিছুকে সম্মান রেখে সার্ভিস দিচ্ছি।

তৃতীয়ত, লাইফস্প্রিং বাংলাদেশে প্রথম, যেখানে সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্ট একসঙ্গে মিলে কাজ করা শুরু করেছি। আমরা এখানে প্রোপার রেফারাল সিস্টেম রেখেছি। ঔষধ লাগলে সাইকিয়াট্রিস্ট সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন, কাউন্সিলিং লাগলে সাইকোলজিস্ট সহায়তা করেন। এখানে রোগী ধরে রাখার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আমাদের থাকে না। মূলত এসব কারণেই মানুষ আমাদের ওপর ভরসা করছেন। আমাদের এখানে বর্তমানে ১৪ জন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন এবং ৪২ জন সাইকোলজিস্ট আছেন। তারা সবাই বিশ্বাস করেন, ঔষধপত্র কম দিয়ে বরং রোগীকে বিজ্ঞানসম্মত কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সারিয়ে তোলা। অনেকেই মনে করেন, মানসিক রোগের চিকিৎসা মানেই জটিল সব ঔষধ, অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ, ইত্যাদি। আমরা এধরনের কালচার থেকে সরে এসেছি।

লাইফস্প্রিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. সাঈদুল আশরাফ কুশল

ইত্তেফাক: আপনারা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। সেই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই।

ইয়াহিয়া আমিন: বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ যারা ঢাকার বাইরে থাকে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ভালো প্ল্যাটফর্ম নেই। আমাদের লাইফস্প্রিংয়ের  বনানী, উত্তরা ও পান্থপথে এবং চট্টগ্রামে একটা সেন্টার চালাচ্ছি, এটি দেশের আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাই। এমনকি ভোলায় একটা সেন্টার করতে চাই, যেখানে খুবই অল্পখরচে প্রান্তিক মানুষদের আমরা সেবা দিতে পারব। মানসিক সমস্যায় ভোগা বেশিরভাগ মানুষ ঢাকার বাইরে থাকেন। কিন্তু এই বিষয়ে সেবাদানকারীদের ৮০ ভাগই ঢাকাভিত্তিক। মফস্বলে গ্যাপ। আমরা সেই গ্যাপ পূরণের জন্য 'সবুজছাতা' ক্লিনিকের মতো একটা সেবা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই।

এছাড়া আমাদের ভিডিও কন্টেন্টগুলো কিন্তু সবাই-ই দেখছেন। বেসিক সমস্যা নিয়ে অনেকে আমাদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করছেন। এছাড়া আমরা গত পাঁচ বছরে ঢাকার বাইরে আমরা প্রচুর প্রোগ্রাম করেছি। অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেইন করেছি। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে, চট্টগ্রামে, কক্সবাজারে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনেকগুলো ক্যাম্পেইন করেছি। মানুষও দারুণ সাড়া দিচ্ছে।

ইত্তেফাক: সাঈদুল আশরাফ কুশল, আপনি একজন ডাক্তার। বিভিন্নধরনের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের মডিউল আমাদের দেশে দেখি। আই ক্যাম্প হয় কিংবা ডায়াবেটিক চেকআপ-এর ক্যাম্প হয়। কিন্তু মেন্টাল হেলথ নিয়ে আপনারা ফ্রি কনসালটেশন ক্যাম্প করছেন, যা নতুন ধরনের ধারণা। এই মডিউল আসলে কীভাবে কাজ করছে?

ডা. কুশল: আমরা মূলত লাইফস্প্রিং ফাউন্ডেশন থেকে এটা শুরু করেছি। অনেকেই প্রাইভেট সার্ভিস এভেইল করতে পারে না। অনেক টিনেজার থাকে, যারা হয়তোবা বাবা-মাকে তার সমস্যার কথা বলতে পারছেন না। তাদের জন্য আমরা বছরে এক কোটি টাকা সমমূল্যের ফ্রি কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করছি। শুধু কাউন্সেলিং না, সাইকিয়াট্রিক সেবাও প্রদান করছি। এটা আমরা দায়িত্ব মনে করে করছি। অন্যদিকে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘন্টা একটা সুইসাইড হটলাইন শুরু করেছি। গত তিনমাস হলো এবং সেখানে দেশ-দেশের বাইরে থেকে যে কেউ আপনার হঠাৎ করে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি ফিল করা শুরু করেন, বা খারাপ লাগে, তাহলে একজন প্রশিক্ষিত কাউন্সিলর বা ডক্টরের সাথে আধাঘণ্টা কথা বলতে পারেন।

আমরা যখন ২০১৭ সালে যখন শুরু করি, আমাদের চিন্তাটাই ছিল যে, কম্প্রেহেনসিভলি মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চাইলে উদ্যোক্তা হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একা-একা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ অনেকেই করছে। কিন্তু টোটাল ইকোসিস্টেম ইম্প্রুভ করতে হলে আরও ক্লায়েন্টসেন্ট্রিক করতে হবে। যদি সাইকিয়াট্রিস্ট-সাইকোলজিস্ট একসাথে কাজ করার মাধ্যমে একটা সেন্টার তৈরি করাটাই এখানে সবচেয়ে বেশি কল্যাণ বয়ে আনবে। ২০১৭ সালে আমরা শুধু স্বপ্নই দেখতাম যে, আমাদের সঙ্গে ১৫০টা মানুষ ফুলটাইম কাজ করবে। বেশ কয়েকজন সাইকোলজিস্ট-সাইকিয়াট্রিস্ট একসাথে কাজ করবেন এবং আমরা প্রায় দেড় লক্ষ-দুই লক্ষ মানুষের সেবা দিতে পারব। এক কোটি মানুষকে আমরা অনলাইনে যুক্ত করতে পারব। সেই স্বপ্নটা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। যদিও মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় আরও অনেক কাজ করা বাকি।

আমাকে প্রচুর সাইকোলজিস্ট-সাইকিয়াট্রিস্ট ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে বলেন যে, ভাই আমি পঞ্চগড়ে চেম্বার করছি, ময়মনসিংহে করছি, সিলেটে করছি। এবং এখানকার মানুষজনও আপনাদের কথা বলে। মানসিক রোগ নামে যে একটা সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে তারা সচেতন হচ্ছেন। আগে মানুষ মনে করতো যে, পাগলের ডাক্তার ওষুধ দেবে। এখন সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে।

আর অন্যদিকে পুরো দেশের মানুষ আমাদের ভিডিওগুলো দেখছেন। এতে অনেকের উপকার হচ্ছে। যেমন- আপনার রাগ আছে, এখন আপনার রাগ আপনি যদি বাসায় বসে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারেন, এটা ভালো সমাধান। রাগের ফলে আপনার সংসার ভেঙে যেতে পারে, আপনার বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে পারে, আপনার চাকরি চলে যেতে পারে। অথচ রাগ কোনো রোগ না। রাগ পুষে রাখলে আমাদের ইকোনমিক্যাল লসও হয়, যেটা আমরা পরিমাপ করতে পারি না। কিন্তু কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে অনেক বড় বড় ক্ষতিও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আবার অনেকসময় ছোট একটা ভিডিও দেখে নিজে থেকেই এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

ইত্তেফাক: কোনো স্ট্যাটিসটিকস শেয়ার করা সম্ভব কি না? সরাসরি কতসংখ্যক মানুষ আপনাদের সেবা নিয়েছেন?

লাইফস্প্রিংয়ের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া আমিন

ইয়াহিয়া আমিন ও ডা. কুশল: গত ছয় বছরে দেড় লাখের বেশি মানুষ আমাদের কাছ থেকে সেবা নিয়েছে। সেটা সাইকিয়াট্রিক হোক সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং হোক। পাশাপাশি আমরা দেখেছি, আমাদের ভিডিওগুলো বাংলা ভাষাভাষী এক কোটিরও বেশি মানুষ দেখছেন, যারা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিজেরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও অবগত করছে। আমি বলব এটা একটা সিগনিফিকেন্ট ফ্যাক্টর। 

ইত্তেফাক: বাংলা ভাষায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এই যে এত কনটেন্ট আপনারা তৈরি করছে, এর পেছনের শক্তি কী?

ইয়াহিয়া আমিন: ২০১৯ এ আমরা যখন ভিডিও করা শুরু করি, বিশাল সংখ্যক মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানতো না। আমরা চেয়েছি মানুষের মাঝে এ নিয়ে ধারণা তৈরি করতে। যাতে মানুষ নিজের সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারে। এখন পর্যন্ত আমরা ৩ হাজার ভিডিও তৈরি করেছি। এরজন্য কোনো এক্সটার্নাল ফান্ডিং নেই। কিন্তু ভিডিও তৈরি করার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা যেমন অব্যাহত ছিল, তেমনি আমরা সহজবোধ্য আলোচনা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে গেছি।

যেমন ধরুন, গায়ের জ্বর বা পেটে সমস্যা হলে মানুষ তার রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারে সচেতন হয়। কিন্তু ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি থাকলে কী কী কনসিডার করা উচিত, কোন বিষয়ে লক্ষ রাখলে মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমানো সম্ভব, সেগুলো সাধারণ মানুষ সেভাবে জানেন না। আমরা ভিডিও'র মাধ্যমে সেগুলো তুলে ধরতে পারছি।

ইত্তেফাক: লাইফস্প্রিংয়ের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

ডা. কুশল: প্রথম কথা, আমাদের সার্ভিস কোয়ালিটি ধরে রাখা। আমরা যেমন চাইলে এখন আরও পাঁচটা ব্রাঞ্চ করতে পারি, কিন্তু করছি না। অনেক জায়গা থেকেই মানুষ অনুরোধ করেন শাখা স্থাপনের জন্য। সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন সেবা নিয়ে আরও শাখা তৈরি করতে হলে আমাদের আরও পরিণত হতে হবে, যেনতেনভাবে করলেই চলবে না। মানুষের বিশ্বাস যেন আরও বাড়ে, পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও যেন সর্বজনীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।

ইত্তেফাক: আপনাদের দুজনকে ধন্যবাদ।

ইয়াহিয়া আমিন ও ডা. কুশল: ইত্তেফাক ডিজিটাল টিমকে ধন্যবাদ।

 

ইত্তেফাক/এআই