বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল (১৯৫৮)। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এ পর্যন্ত তিনি ১৯টি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। কবিতা নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন। কবিতায় নতুন নতুন ফর্ম, স্ট্রাকচার ও ভাষা সৃষ্টিতে তার জুড়ি মেলা ভার। তার কবিতায় গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ণ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জীবনের জটিলতা, প্রেম-বিচ্ছেদ, পরবাস, পরাবাস্তব, অন্যায়ের প্রতিবাদসহ প্রভৃতি বিষয় প্রতিফলিত হয়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ পাওয়ার অনুভূতি ও সাহিত্যচর্চার নানা দিক নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইত্তেফাকের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক দীপংকর দীপক।
বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ অর্জন করেছেন। আপনার অনুভূতি কী?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি মূলত পুরস্কারবিরোধী একজন মানুষ। পুরস্কার পেতেই হবে—এরকম কোনো কথা নয়। পাঠকদের ভালোবাসাই আসল কথা। এর আগে আমি তিনবার বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রবাসী এবং ওয়ালিউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ব্যক্তিস্বার্থে একাডেমিকে ব্যবহার করে তথাকথিত ‘প্রবাসী সাহিত্য পুরস্কার’ চালু করেছিলেন। দুবার এ পুরস্কার নেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি সম্মত হয়নি। কারণ প্রবাস থাকলেও আমি নিজেকে প্রবাসী লেখক মনে করি না। একই অনুরোধ করেছিলেন—বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীও। এ ধরনের সান্ত্বনামূলক পুরস্কার বা বি ক্যাটাগরির পুরস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। তবে এবারের পুরস্কার আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে।
তবে আপনি কী কবিতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কারটি পেতে পারতেন না?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এ কথা বলতে দ্বিধা নেই—আমি মূলত কবি। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও অনেক গবেষণাধর্মী বই লিখেছি। আমার ১৯টি বই-ই তাকে কেন্দ্র করে লেখা। এসব বইয়ের মধ্যে ১৫টি মৌলিক ও ৪টি সম্পাদনাগ্রন্থ। আমি নিজের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করি। তাই এ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েও আমি গর্ববোধ করছি। এটা আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। পুরস্কার গ্রহণের সময় তার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছিল?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: পুরস্কার গ্রহণের মঞ্চে অল্প সময় পাওয়া যায়। তাই সময় নিয়ে কথা বলা সম্ভব হয় না। আমি মঞ্চে উঠেই প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দেই। তিনিও সালাম গ্রহণ করেন। আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে বলি—‘ আপা কেমন আছেন?’ তিনি হেসে আমাকেও জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কেমন আছো?’ এরপর তিনি আমার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এসময় আরেকটি কাজে তিনি সহায়তা করেছেন। আমি ক্রেস্ট, সনদপত্রসহ অন্যান্য উপকরণসামগ্রী ঠিকমতো ধরতে পারছিলাম না। তিনি তখন বলেন, ‘আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’ তারপর তিনি ক্রেস্টবাক্স ভাঁজ করে গুছিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দেন। সত্যিই তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ।
যতদূর জানি, আপনি সরকারি চাকরি করতেন। আর কবিতা লেখার জন্যই আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। সেই সময়ের কথা একটু বিস্তারিত বলুন—
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এটি ১৯৯৬ সালের ঘটনা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে বের হয় আমার প্রথম গবেষণাধর্মীগ্রন্থ—‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’। আমি যা-ই লিখি তা নাকি সরকারের বিপক্ষে যায়—এমন কারণ দেখিয়ে অন্যায়ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করে বিএনপি সরকার। এর প্রতিবাদে দেশ-বিদেশের পাঁচ শতাধিক লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ বিবৃতি দেন। আমি সবসময়ই স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক সরকারে বিরুদ্ধে কথা বলেছি। ’৯০ এর দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম, ‘ঘাতকের হাতে সংবিধান’। সেসময় বইটি বেশ আলোচনায় এসেছিল। অনেকেই সেদিন আমার সাহসিকতার তারিফ করেছিলেন। এছাড়াও আমার স্বরব্যঞ্জন প্রকাশনী থেকে এক প্রবাসীর কবিতার বই ‘শয়তানের নয়ন বারি’ ২০০৪ সালে বের হয়। এর প্রতিবাদে মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে নামে। এসব কারণে আমাকে তৎকালীন সরকার ও মৌলবাদীদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
প্রবাসে থেকে বাংলা সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখা কতটা কঠিন বলে মনে হয়?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আবার বলছি, আমি নিজেকে প্রবাসী মনে করি না। সুদূর কানাডায় থাকলেও বাংলা ও বাংলাদেশ আমার অন্তরজুড়ে। তাছাড়া এই ডিজটাল যুগে—এটা একটা অবস্থানগত দূরত্ব মাত্র। আমি প্রতিটি মুহূর্তে বাংলাদেশ, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে আছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় এ দেশের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখছি, লাইভ অনুষ্ঠান করছি। সময় নিয়ে বছরে দু-একবার দেশে আসছি। তাছাড়া আমি দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত আছি। তাই আমি সশরীরে প্রবাসে থাকলেও আমার মন-মনন, কাজকর্মসহ সবকিছুই এ দেশ-মাটি ও মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত।
অনেকে বলে থাকেন বাংলা কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। আপনি কী মনে করেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বাংলা কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে বলা ঠিক হবে না। কবিতা এখন বিভিন্ন মাধ্যমে পড়া যাচ্ছে। অনলাইন বা প্রযুক্তির কারণে অনেকে হয়তোবা বই পড়ছে না। তবে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতা প্রকাশের সুযোগ থাকায় সেখানেও একটি পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠছে। তাছাড়া এখন বিদেশে থেকেও বাংলা কবিতা পাঠের সুযোগ রয়েছে। বিজ্ঞান আর আধুনিকতার কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে।