স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। দেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করছেন মেয়ে শিক্ষার্থীরা। তাদের যোগ্যতার প্রমাণ মিলছে প্রায় প্রতিটি দপ্তরে। এরপরও সুদীর্ঘ সময়ে দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য কতটা ঘুঁচল? সেই প্রশ্নের উত্তরে দেখা মিলছে, দুয়েকটি নারীবান্ধব আইন কিংবা বাড়তি সুযোগ সুবিধার বলে সমাজের উঁচু শ্রেণির নারীরা কিছুটা সুবিধাভোগী হলেও চরম বৈষম্য বিরাজ করছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজে। শারীরিক শক্তিতে সমান পরিশ্রম করলেও সবজায়গায় মিলছে না সমান অধিকার। এখনো একজন পুরুষের অর্ধেক মজুরিও জোটে না অনেক দিনমজুর নারীর কপালে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরকারি-বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী পুরুষের বেতন বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো অনেক। আনুষ্ঠানিক খাতে প্রতিটা পদের বিপরীতে বেতন নির্ধারিত থাকে বলেই সেখানে বৈষম্যের সুযোগ অনেকটাই কম। অনানুষ্ঠানিক খাতে কত বেতন হবে, কাকে কত টাকা মজুরি দেওয়া হবে, তার কোনো হিসাব নেই। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক এবং এই খাতে নারীই বেশি যুক্ত। এ ছাড়া সামাজিক ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং নারীর নমনীয় মনোভাবের কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলও বলছে, দেশে সার্বিক কর্মসংস্থান বাড়লেও শহর এলাকায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। বিশেষ করে শিল্প খাতেই নারী শ্রমিক কমার প্রবণতা বেশি। এদের একটা অংশ গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্ন মজুরিতে কিংবা বিনা মজুরিতে গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে যুক্ত হচ্ছেন।
বৈশ্বিক জেন্ডার বৈষম্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সুখকর নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা এখনো প্রায় ২৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনো ৫৬ শতাংশ। নানা ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও, নারীর কাজ আয়মূলক হচ্ছে না। বরং যেসব খাতে নারীর কাজের মজুরি ও পদ-ক্ষমতা পুরুষের সমান, সেইসব কাজ থেকে নারী ছিটকে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্থা সামাজিক দায়বদ্ধতার আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু বেতনে বৈষম্য থাকছে।
বাংলাদেশে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীর মতোই উৎপাদনশীল ও উদ্যোগী হতে পারে। কিন্তু ভূমি, ঋণব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার- কোনোখানেই তাদের সমান প্রবেশাধিকার নেই। কৃষিতে বেশিরভাগ নারীর অবদান অদৃশ্য থাকে। কাঠামোগত বাধা ও নেতিবাচক সামাজিক রীতি নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও অংশগ্রহণকে সীমাবদ্ধ করে চলেছে। বেশিরভাগ পরিবারে বৈষম্যমূলক চর্চার কারণে গ্রামীণ এলাকার নারী ও মেয়েশিশুদের উৎপাদনশীল সম্পদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো খাত এবং পানি ও স্যানিটেশনের মতো অবকাঠামোগত বিষয়গুলোতে সমান প্রবেশাধিকারের ঘাটতি আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বব্যাপী জেন্ডার ও উন্নয়নসূচকগুলোতে দেখা যায়, গ্রামীণ নারীদের অবস্থা গ্রামীণ পুরুষ কিংবা শহুরে নারীদের চেয়ে খারাপ। তার ওপর দারিদ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হয় অসম।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা কম নয়। বিশেষ করে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স তৈরির ক্ষেত্রে। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, গ্রামীণ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও প্রতিবেশগতভাবে টেকসই পরিবেশব্যবস্থা গড়তে পরিবেশের ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে গ্রামীণ নারীর ভূমিকা একটি এন্ট্রি পয়েন্ট হতে পারে। এখন সময় এসেছে গ্রামীণ নারীদের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার। দেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে ও দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় শক্তি হিসেবে নিজেদের সঠিক স্থান দাবি করার সময় এসেছে। কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছে যে, দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত সাফল্যের বেশিরভাগ অবদান 'পর্দার পেছনে থাকা' গ্রামীণ নারীদের?