মিয়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে সবশেষ ১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে জান্তা সরকার। এদের মধ্যে শত শত মুসলিম থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা দেশজুড়ে জুমার নামাজের সময় ভূমিকম্পটি আঘাত হানায় বহু মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্প্রিং রেভোলিউশন মায়ানমার মুসলিম নেটওয়ার্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর মান্দালয় এবং সাগাইং অঞ্চলে আনুমানিক ৫০০ থেকে ৭০০ জন মুসলিমের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে সারাদেশে ৫০টিরও বেশি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মান্দালয়ে বাড়ির পাশের একটি মসজিদে নামাজের আগে অজু করছিলেন হেত মিন ও। সেই সময় মসজিদের একাংশের সঙ্গে তার বাড়িটিও ধসে পড়ে। তার শরীরের অর্ধেক অংশ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় এবং তার দুই খালাও চাপা পড়ে যায়। স্থানীয়রা তাদের বের করার জন্য দৌড়ে যায়, কিন্তু তিনি ছাড়া প্রায় সবাই মারা যান।
আল জাজিরার বরাত দিয়ে রয়টার্সকে ২৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, তার দুই চাচা এবং দাদিও ধ্বংস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন। ভারী কোনো সরঞ্জাম না থাকায় তিনি হাত দিয়ে ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা পারেননি।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, আমি জানি না ধ্বংসস্তূপের নিচে তারা বেঁচে আছে কি না। এতদিন পরেও আমার মনে হয় না আর কোনো আশা আছে। অনেক ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে। কোনো উদ্ধারকারী দল আমাদের সাহায্য করতে আসেনি।
Mandalay’s historic Shwe Boan Shein Mosque, in Myanmar destroyed. Dozen dead or missing inside. #earthquake pic.twitter.com/dBGiMeCHhx
— Anonymous (@YourAnonCentral) March 28, 2025
মান্দালয় অঞ্চলের ৩৯ বছর বয়সী এক বাসিন্দা স্থানীয় সুলে কোনে গ্রামে ধসে পড়া মসজিদের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের নিয়ে ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা দেন। তিনি বলছিলেন, আমি নিজের সঙ্গে মসজিদে চারজনকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তিন জন মারা যায়। একজন আমার কোলে মারা গিয়েছিল।
তিনি জানান, ওই মসজিদটিতে ১০ জন মারা গেছেন। আরও তিনটি মসজিদ ধসে পড়ায় তাদের গ্রামে মোট ২৩ জন নিহত হয়েছেন। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে মসজিদ ভবন সংস্কার করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান।
বৌদ্ধ অধ্যুষিত মায়ানমারে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। তারা ধারাবাহিকভাবে সরকারের নিপীড়িত এবং প্রান্তিকীকরণের শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৌদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোও সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।
কয়েক দশক ধরে মায়ানমার কর্তৃপক্ষ মুসলিমদের জন্য মসজিদ মেরামত বা নির্মাণের অনুমতি পাওয়া কঠিন করে তুলেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর অবস্থার অবনতি হয়েছে।
মান্দালয়ে আরেকটি মসজিদ ভূমিকম্পে ধ্বংস হওয়ার পর জুলিয়ান কাইল নামে এক ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় কংক্রিটের স্তম্ভ তোলার জন্য ভারী যন্ত্রপাতি চেয়ে অনুরোধ করেন। তিনি লিখেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং অন্যরা চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। আমরা অন্তত তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাতে চাই।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টাউংনু শহরের একজন বাসিন্দা বলেন, তিনি নামাজ পড়ছিলেন। ঠিক তখনই কান্দাও মসজিদের একপাশ ভেঙে পড়ে তার সামনে বসা দুই সারির লোকদের উপর।
তিনি বলছিলেন, আমি মসজিদ থেকে অনেক লোককে বের করে আনতে দেখেছি, তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার চোখের সামনেই মারা গেছেন। এটা সত্যিই হৃদয়বিদারক।
সামরিক সরকারের মতে, ভূমিকম্পে বৌদ্ধ ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েচে। ৬৭০টি মঠ এবং ২৯০টি প্যাগোডা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে তাদের প্রতিবেদনে মসজিদের ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে মিয়ানমারজুড়ে ভবন, সেতু এবং অন্যান্য রাস্তাঘাটও ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে দুর্যোগের প্রকৃত মাত্রা এখনো প্রকাশিত হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।