বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

ক্ষমতা এক মহান দায়িত্বের নাম 

আপডেট : ০৩ মে ২০২৫, ০৬:০০

লোভের জিহ্বা অত্যন্ত ভয়ংকর। বিশেষ করিয়া যিনি ক্ষমতার চেয়ারে আসীন হন, তাহাকে অধিক দায়িত্বশীল হইতে হয়। সংবরণ করিতে হয় নিজের জিহ্বাকে। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের যেমন বলিয়াছেন-আমরা যেন আমাদের মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণে রাখি-তেমনি ক্ষমতায় যাহারা আসীন থাকেন, তাহাদেরও মনে রাখিতে হইবে, তাহারা চিরকাল সেই ক্ষমতার চেয়ারে আসীন থাকিবেন না। অতীতেও কেহ চিরকাল ছিলেন না, ভবিষ্যতেও থাকিবেন না। কোনো চেয়ারই স্থায়ী নহে। কিন্তু বেশির ভাগ অপরিণত মানুষ ক্ষমতার গরম চেয়ার পাইয়া তাহাদের মস্তিষ্ককে উষ্ণ করিয়া ফেলেন। তাহারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। ক্ষমতার অংশ হইবার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন তাহাদের সম্মুখে অঝোর বৃষ্টির মতো ঝরিতে থাকে। সেই প্রলোভনে পা দিয়া অনেকেই নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া ফেলেন। তখন তিনি জনগণের সম্পদকে নিজের সম্পদরূপে ব্যবহার করিতে থাকেন। অথচ তাহা এক ভয়ংকর খেয়ানত, যাহার পরিণতি অত্যন্ত করুণ।

বস্তুত, ক্ষমতা অবিচক্ষণ মানুষকে ঔদ্ধত্য ও দুর্নীতিপরায়ণ করিয়া তোলে। ক্ষমতা মানুষের অন্তর্নিহিত প্রবণতাকে প্রকাশ করিয়া দেয়। এইখানেই প্রয়োজন হয় সংবরণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বিবেকবোধের। মানব জিহ্বা অতি শক্তিশালী এক অস্ত্র। ইহার মাধ্যমেই একটি সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা পায়, আবার এই জিহ্বাই কখনো সমাজকে বিভক্ত করিয়া দেয়। মহান আল্লাহতায়ালা এই জন্য বলিয়াছেন যে, আমাদের এমন কথা বলা উচিত নহে, যাহা আমরা নিজে পালন করি না। এই নির্দেশ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তাহারা যদি নিজেদের জিহ্বা সংবরণ না করেন, তাহা হইলে তাহার প্রভাবে সমাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। একজন মানুষের ভালোভাবে বাঁচিবার জন্য কতটুকু প্রয়োজন?

অধিক ভোগের আকাঙ্ক্ষায় ক্ষমতার অপব্যবহার একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হইলে ইহার প্রভাব সীমিত থাকে না। বরং ইহা বৃহত্তর সমাজ-জীবনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ভঙ্গুর হইয়া পড়ে। সমাজের বৃহত্তর মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং আইনের শাসন দুর্বল হইয়া পড়ে। সুতরাং একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কেবল নিজের নহে, বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য সততা, সংযম ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করিতে হইবে। 

ক্ষমতা, তাহা যত ক্ষণিকেরই হউক না কেন, এক মহান দায়িত্বের নাম। কোনো ব্যক্তি যখন মহান আল্লাহর আনুকূল্যে ক্ষমতার আসনে আসীন হন, তখন তাহার কথাবার্তা, আচরণ, তাহার প্রতিটি পদক্ষেপ জনগণের জন্য একটি বার্তা বহন করিয়া আনে। ইহা কেবল আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ নহে, বরং ইহা একটি আমানত-যাহার জবাবদিহিতা থাকিবে ঊর্ধ্বতন সত্তার নিকট, থাকিবে ইতিহাসের দরবারে, এবং থাকিবে সেই সকল মানুষের সম্মুখে, যাহারা তাহাকে বিশ্বাস করিয়া দায়িত্ব প্রদান করিয়াছেন। এই জন্য বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো বলিয়াছিলেন, 'একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়, যখন সে ক্ষমতার অধিকারী হয়।' ইতিহাস আমাদের বারংবার দেখাইয়াছে, যে ব্যক্তি নিজেকে অপরিহার্য মনে করিয়াছেন, একসময় তিনিই ভুলিয়া গিয়াছেন-চেয়ারের চাকা ঘুরিতে ঘুরিতে যাহারা একদিন শীর্ষে উঠিয়াছিলেন, তাহারা আবার মাটিতেই পতিত হইয়াছেন। রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস বলিয়াছেন, 'রিমেমবার দ্যাট ইউ আর জাস্ট আ ম্যান।' এই কথাটি সকল ক্ষমতাধর ব্যক্তির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন।

মনে রাখা আবশ্যক-ক্ষমতার স্বাদ যত মধুর হউক, ইহার দায়িত্ব ততই ভারী। 'পাইলাম আর খাইলাম'-এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য চরম অবিবেচনার প্রকাশ। আল্লাহ যাহাকে সামান্যতম ক্ষমতাও দান করেন, তাহাকে সেই ক্ষমতা এমনভাবে ব্যবহার করিতে হইবে, যাহাতে ইহা জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়, এবং কোনোরূপ অন্যায়-অন্যায্যের উপায় হইয়া না উঠে। কারণ, তাহাদের ক্ষমতার সহিত জড়াইয়া রহিয়াছে সংশ্লিষ্ট জনগণের বাঁচা-মরার বিষয়।

ইত্তেফাক/এএম