বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০১

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সুখবরের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে সবার মধ্যে আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম এত অল্প সময়ে এযাবতৎ কমপক্ষে চারটি ভ্যাকসিনের সাফল্যের খবর বিজ্ঞানের জয়যাত্রারই আরও একটি বার্তা।

সফল এই ভ্যাকসিনগুলো ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা আর জামালিয়া (স্পুটনিক-৫) আবিষ্কার করেছে। এই ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশ, অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ (ত্রুটিযুক্ত ফলাফল হিসেবে সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে) আর জামালিয়া (স্পুটনিক-৫)-এর ৯২ শতাংশ। আমরা আশা করতে পারি, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এ বছরই মানবদেহে এগুলোর প্রয়োগ শুরু হবে। যদি জামালিয়া (স্পুটনিক-৫) ভ্যাকসিনটির প্রয়োগ এ সপ্তাহেই শুরু হবে বলে আমরা জেনেছি।

সম্প্রতি অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাত্রাজনিত ত্রুটি ধরা পড়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এস্ট্রাজেনাকা এই ত্রুটির বিষয়টি মেনে নিয়েছে এবং নতুন করে বিশ্বব্যাপী ট্রায়ালের কার্যক্রম শুরু করেছে। এই ত্রুটির পরেও যুক্তরাজ্য সরকার দেশের ওষুধ রেগুলেটরি সংস্থাকে ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণের অনুরোধ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে, শিগিগর এই ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব হবে বা এটি প্রয়োগের অনুমতি অনেক দেশই প্রদান করবে।

এই ভ্যাকসিনগুলোর সফলতার খবরের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর সফল প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিশ্বের সব দেশের জন্যই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে এটি সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে, সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে পৌঁছানো যেমন জরুরি, তেমনি যিনি এটি গ্রহণ করছেন তার তথ্য-উপাত্তও সঠিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করারও দরকার রয়েছে। তাই ভ্যাকসিনের সফলতা অর্জনের জন্য একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। অনেক দেশই ইতিমধ্যে কোভিড ভ্যাকসিন কার্যক্রমের পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী বছরের মার্চ থেকে দেশটিতে বয়স্ক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হবে এবং ২০২১ সালেই দেশটির প্রতিটি নাগরিক ভ্যাকসিন গ্রহণের সুযোগ পাবে। আর এজন্য দেশটি চারটি ভ্যাকসিন উত্পাদন কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাকসিন কিনেও ফেলেছে। ভ্যাকসিন কোন এলাকায়, কীভাবে, কোন সময়ে জনগণের মধ্যে প্রয়োগ করা হবে তার পরিকল্পনাও মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। এই ভ্যাকসিনগুলোর একটি বিরাট অংশ দেশটিতেই উত্পাদিত হবে। ভ্যাকসিন যে শুধু দেশটির কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দেবে তাই নয়, এটি নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য ডিজিটাল ভ্যাকসিন পাসপোর্টের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহূত হবে। ভ্যাকসিন নিয়ে এমন পরিকল্পনা আর অগ্রগতি অনেক দেশই করে ফেলেছে।

বাংলাদেশ আশা করছে ভ্যাকসিন সংগ্রহের। সরকার তিন কোটি ভ্যাকসিন বিনামূল্যে জনগণকে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে যে জটিলতা আছে তা অস্বীকার করা যাবে কি?

আমরা যতটুকু জেনেছি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন বাংলাদেশে সরবরাহ করবে ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এই ভ্যাকসিন উত্পাদনের দায়িত্ব পেয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে এজন্য বেক্সিমকো একটি চুক্তি করেছে। বেক্সিমকো বাংলাদেশ সরকারকে দেড় কোটি নাগরিকের জন্য ৩ কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহ করবে। বেক্সিমকো বলছে, যখনই এই ভ্যাকসিন ব্রিটেনে কিংবা আমেরিকায় অনুমোদন পাবে, তার এক মাসের মধ্যেই এটি বাংলাদেশে আনা সম্ভব হবে এবং এরপর প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে সরবরাহ এবং জনগণের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। আমরা জেনেছি, ভ্যাকসিন সাপ্লাই চেইনকে ফলপ্রসূ করার জন্যই সরকার বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। হিসাব করলে দেখা যায়, মার্চ থেকে শুরু করলেও দেড় কোটি মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতেই সেপ্টেম্বর অবধি লেগে যাবে। সম্প্রতি ভ্যাকসিন জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি)-এর মাধ্যমে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের (জনসংখ্যার ২০ শতাংশ) জন্য বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পেতে পারে। কিন্তু শর্ত হলো, বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্যাভির কাছে প্রদান করতে হবে।

১৭ কোটি মানুষের বাকিদের ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ আমাদের নজরে আসেনি। আমরা যদি ভারতের মতো বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষের মধ্যেও অ্যান্টিবডি তৈরির কথা বিবেচনা করি এবং ৫০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকল্পনা করি, তবু ১৭ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন পড়বে। গ্যাভির ভ্যাকসিনের আশ্বাসকে বিবেচনায় আনলে সব মিলিয়ে ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজের নিশ্চয়তা রয়েছে বাংলাদেশের।

কোভিড ১৯ থেকে সুরক্ষায় অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের সঙ্গে অন্য ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহের জন্য সফল উদ্যোগ গ্রহণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেওয়া দরকার। একই সঙ্গ এই ভ্যাকসিনগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য সব ধরনের পরিকল্পনাও করা দরকার। বাংলাদেশে বিপুল জনসংখ্যার মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে কাদের, কোন এলাকায়, কীভাবে, কোন সময়ে এটি প্রয়োগ করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। যেহেতু দুই দফায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে, তাই ভ্যাকসিন প্রাপককে যথাযথ অনুসরণযোগ্য পদ্ধতিরও প্রয়োজন রয়েছে। অল্প সময়ে যত বেশি নাগরিককে এই ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব হবে, দেশের জন্য তত দ্রুত মঙ্গল বয়ে আনা সম্ভব হবে। আর এর জন্য দক্ষ জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট ও ডাটা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাও অত্যাবশ্যক।

প্রতিটি ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন ফাইজার ও মডার্নার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের জন্য হিমাংকের নিচে যথাক্রমে ৭০ ও ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। মর্ডানার ভ্যাকসিন এক মাস পর্যন্ত এবং ফাইজারের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ৫ দিন পর্যন্ত ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা সম্ভব। তাই এ ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার জন্য ভ্যাকসিন সংগ্রহের পর থেকে প্রাপকের শরীরের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ ও এর কার্যক্ষমতা পুরোপুরি অনুসরণ করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞরা এজন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তির কথা বিশেষভাবে চিন্তা করছেন।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, টিকাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, সাপ্লাইচেইন ও ব্লকচেইন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, নীতি নির্ধারক, প্রশাসক ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কর্মিবাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে, যারা এই কাজকে পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সফলভাবে কার্যকর করতে পারবেন।

লেখক: কৃষিবিজ্ঞানী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন