বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বুক চিতিয়ে লড়ে গেলো অপরাজেয় সুন্দরবন

আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:১৮

প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত কাটতে না কাটতেই আবারও প্রলয় ঝড় ‘বুলবুল’। বরাবরের মত এবারও উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করতে বুক চিতিয়ে লড়াই করলো সুন্দরবন। সিডর, আইলার পর বুলবুলের চোখে চোখ রেখে এবারও অপরাজেয় সুন্দরবন। বাঘের মত গর্জে ওঠা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ প্রথমে শনিবার বিকেলে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে আঘাত হানে। এরপর রাত

সাড়ে ১০টার দিকে এটি বাংলাদেশের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে ঢুকে পড়ে।  দুই দেশের সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে দুর্বল ‘বুলবুলের’ কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে যায়। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে গত শুক্রবার বেলা ১২টার পর থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শনিবার বিকালের পর থেকেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের দুবলার চরে আঘাত হানার পর থেকেই দমকা হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়। 

সুন্দরবন উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার হুমকি নিয়েই ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’কে রুখে দিতে সরকারের নানা তোড়জোড়, সর্বাত্মক প্রস্তুতি ছিল। নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সুন্দরবন উপকূলের  ৫ লক্ষাধিক মানুষকে। প্রস্তুত ছিল ১০টি যুদ্ধজাহাজ। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা, উদ্ধার তৎপরতা ও জরুরি ত্রাণ বিতরণের জন্য প্রস্তুত ছিল সেনাবাহিনী। খুলনাসহ উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়।

খুলনা জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানান, শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন উপকূলে প্রথম আঘাত হানে। রাত তিনটার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কয়রা অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের দিকে ধাবিত হয়। ভোর ৫টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি ৬০ কিলোমিটার বেগে খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। তবে নদীতে জোয়ার না থাকায় আইলার মত জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেনি। 

এদিকে, পূর্বাভাসে যতটা ‘গর্জন’ ছিল, বাস্তবে ততটা বর্ষেনি ‘বুলবুল’। উপকূলের ২০০ কিলোমিটারে প্রবেশের পথে শক্তি কমতে থাকে। স্থলভাগে ‘ছোবল’ মারার সময় ঘূর্ণিঝড়টির গতি আরও কমে যায়। রবিবার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনাঞ্চল অতিক্রম করে ‘স্থল নিম্নচাপ’ পরিচয়ে। 

তবে বড়ো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও খুলনা জেলায় বুলবুলের আঘাতে ঘর ও গাছ চাপা পড়ে এক নারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন। রবিবার সকাল ১০টার দিকে দাকোপ উপজেলার দক্ষিণ দাকোপ গ্রামে বুলবুলের আঘাতে ঘর চাপা পড়ে প্রমিলা মণ্ডল (৫২) নামে এক বৃদ্ধা নিহত হন। 

আরও পড়ুন: ঝড়ের কবলে পড়ে বরিশাল বিদ্যুৎহীন, গাছ চাপায় নারীর মৃত্যু

স্থানীয়রা জানান, সকাল ১০টার দিকে প্রমিলা মণ্ডল সাইক্লোন শেল্টার থেকে দক্ষিণ দাকোপ গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে আসেন। তিনি ঘরে ঢুকার পর শিরিষ ও নারকেল গাছ ঘরের ভেঙ্গে পড়লে তিনি ঘর চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তিনি দক্ষিণ দাকোপ গ্রামের সুভাষ মণ্ডলের স্ত্রী। এছাড়া সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে গাছ চাপা পড়ে আলমগীর (৩৫) নামে অপর এক যুবক নিহত হন। তিনি সেনহাটি গ্রামের শফিউদ্দীন মিস্ত্রির ছেলে।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ৪ ঘণ্টার তাণ্ডবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ ও কয়রার তিন সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং গাছপালা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। 

খুলনা জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম জোয়ার্দার বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে কয়রা উপজেলায় এক হাজার পাঁচশ ও  ও দাকোপ উপজেলায় এক হাজার সাতশসহ খুলনা জেলায় তিন সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া বহু গাছপালা উপড়ে ও ভেঙ্গে গেছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) বসিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবন প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলাসহ বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ছোবল থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদকে রক্ষা করেছে। এবারো মায়ের আঁচলের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা  করেছে সুন্দরবন। এই সুন্দরবনকে রক্ষা করা উপকূলীয় এলাকার মানুষসহ দেশবাসীর। তিনি বলেন, সুন্দরবন বেঁচে থাকলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাবে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূল অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদ।

উল্লেখ্য, এবারের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের নাম দিয়েছেন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদরা। জাতিসংঘের আওতায় গঠিত সংগঠন ইউএনএস্কেপের মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার আবহাওয়াবিদরা বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করে থাকেন।

ইত্তেফাক/এসি