প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজ বনভূমির মাঝে দৃষ্টিনন্দন লেক আর লাল ইটের তৈরি ইমারত ক্যাম্পাসকে আরো নান্দনিক করে তুলেছে। পাশাপাশি এ ক্যাম্পাস সংস্কৃতির রাজধানী নামেও পরিচিত। এছাড়া প্রতিবছর শীতকাল এলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলো অতিথি পাখিতে ভরে যায়। তাই জাবিকে অতিথি পাখির ক্যাম্পাস বলেও চেনেন অনেকে। এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত কয়েকটি ভাস্কর্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সবুজের মাঝে কংক্রিটের তৈরি ভাস্কর্যগুলো দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি হয়ে। এসব ভাস্কর্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস পৌঁছে দিচ্ছে।
অমর একুশ
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে নিহত হয়েছেন বাবা-মায়ের বীর সন্তান। সেই বীর সন্তানের লাশ বুকে জড়িয়ে রেখেছেন মা। পাশেই ছেলে হারা বাবা হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। এভাবে হায়েনাদের গুলিতে নিহত ছেলের লাশ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়ের করুণ মুহূর্তটি ফুঁটে উঠেছে ‘অমর একুশ’ ভাস্কর্যে। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ এমনই একটি পরিবারের চিত্র ‘অমর একুশ’ ভাস্কর্যে তুলে ধরেছেন ভাস্কর জাহানারা পারভীন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক (ডেইরি গেট) দিয়ে প্রবেশ করে কিছুটা পথ যেতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া ও সমাজ বিজ্ঞান ভবনের মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়িয়ে আছে অমর একুশ ভাস্কর্য। ১৯৯১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন।
সংশপ্তক
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনাকে স্মরণ রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’। যুদ্ধে পরাজয় ও নিজের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও লড়াই করে যে অকুতোভয় বীর, সেই সংশপ্তক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক পায়ে ভর করে রাইফেল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়েও রাইফেল হাতে লড়ে যাওয়া দেশমাতৃকার বীর সন্তান। ১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ ভাস্কর্যটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ। এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করা হয়। ভাস্কর্যটির নির্মাতা শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্রোঞ্জের শরীরে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ভাস্কর্যটি যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
দেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রতিনিয়ত স্মরণ করিয়ে দেয় সেই আত্মত্যাগী ভাষাশহীদদের কথা, যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করেছেন রাজপথ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দূর থেকে চোখে পড়ে লালচে রঙের সুউচ্চ শহীদ মিনারটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব স্থাপত্য-ভাস্কর্য আছে তন্মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন এ শহীদ মিনারের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। শহীদ মিনারের উচ্চতা ৭১ ফুট, যা দেশের শহীদ মিনারগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানিয়ে এ শহীদ মিনারের স্তম্ভের উচ্চতা ৭১ ফুট করা হয়েছে। শহীদ মিনারের ভিত্তিমঞ্চের ব্যাস রাখা হয়েছে ৫২ ফুট যা ৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শহীদ মিনারের ভিত্তিমঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে ৮টি সিঁড়ি, যা দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় জীবনের স্বাধীনতা অভিমুখী নানা তাৎপর্যমন্ডিত ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত ৮টি ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রতীক। শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, যা প্রথমত বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, দ্বিতীয়ত মাটি-মানুষ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তৃতীয়ত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতান্ত্রিক চেতনা প্রভৃতি বিষয়কে নির্দেশ করে। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন।
লেখক: আরিফুজ্জামান উজ্জল, দৈনিক ইত্তেফাকের জাবি সংবাদদাতা