বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সীতাকুণ্ডের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’

মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় সেনাদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য

আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:২০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ভারতীয় সেনাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কোলে নির্মিত হয় প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ ভাস্কর্যটি।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় বর্বর কাপুরুষোচিত হামলা চালায়। এতে অপ্রস্তুত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাঙালি  মুক্তিযোদ্ধারা দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশি ও ভারতীয় শহীদদের রক্তের মিলিত স্রোতধারায় যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই ইতিহাস স্মরণে সীতাকুন্ডে স্থাপন করা হয় ভাস্কর্য ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’। একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য অন্য একটি দেশের মানুষের অকাতরে জীবন দেয়ার এমন নজির পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।

সীতাকুণ্ডের ছোট দারোগাহাট হতে কুমিরা এলাকায়  ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।  এরমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার বাহিনী ভিন্ন পরিকল্পনায় মেতে ওঠে। বিজয়ের প্রহর গুনতে থাকা মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর উপর সেসময় হামলা চালায় পাক বাহিনী। ১২ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সম্মুখ যুদ্ধ হয়। স্থানীয় দেশপ্রেমিক জনসাধারণও অংশ নেন যুদ্ধে। বীরত্বপূর্ণ এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য সদস্য শহীদ হন।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট দারোগারহাট হতে কুমিরা পর্যন্ত সড়কের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থান নেয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা ১২ ডিসেম্বর বিকাল নাগাদ শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতেই সীতাকুণ্ড সদর হানাদারমুক্ত হয় । যদিও সীতাকুণ্ডের অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধ চলতে থাকে। এদিকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ বন্ধ করে উল্লাস করতে থাকে। কেউ কেউ নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান। ঠিক এমনি সময়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকা ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় পাকিস্তানিরা। এতে সীতাকুণ্ডে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ করে মিত্রবাহিনী। এই যুদ্ধ রাত পর্যন্ত চলে। এবার টিকতে না পেরে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী। এই দীর্ঘ সময়ের টানা যুদ্ধে প্রাণ হারান শতাধিক ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা। 

পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাদের লাশ উদ্ধার করে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে গজারিয়া দিঘির পাড়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করে তাঁদের দাহ করা হয় এবং মুক্তিবাহিনীর শহীদদের বর্তমান উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকায় দাফন করা হয়।

মিত্রবাহিনীর আত্মদানের এই স্মৃতি ধরে রাখতে সেখানে তথা চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থের সীতা দেবীর কুণ্ডের ওপর হনুমান মন্দিরের সামনে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্মাণ করে ভাস্কর্য 'মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র'। এই স্মৃতিস্তম্ভের পেছনে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং সামনে ফুলের বাগান রাখা হয়েছে।

সীতাকুণ্ডে মিত্র বাহিনীর সমাধিস্থলে মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র নামে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পটি জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে করা হয়েছে। 

লেখক: মেজবাহ উদ্দীন খালেদ, সাংবাদিক, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন