বাংলাদেশে প্রতি বছর যে সংখ্যক পশু জবাই করা হয়, তার প্রায় ৫০ ভাগই হয়ে থাকে কোরবানির ঈদে। জবাই করা পশুর বর্জ্য-রক্ত, নাড়ি-ভুড়ি, গোবর, হাড়, খুর, শিং যথাযথ ব্যবস্হাপনা ও জনসচেতনতার অভাবে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কোরবানির বর্জ্য যত্রতত্র ফেললে পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়, মশা-মাছির চারণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, নালা বা নর্দমায় ফেলা বর্জ্য থেকে ছড়ায় নানা ধরনের রোগজীবাণু। অতিরিক্ত বর্জ্যের চাপে নর্দমা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অল্প বৃষ্টিতেই নর্দমার পানি আটকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। তখন সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার এসব বর্জ্য অপসারণেও হিমশিম খেতে হয়।
বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কোরবানির ঈদের আগে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বর্জ্য অপসারণ সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়, জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালায়। তাছাড়া সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ প্রায় সব গণমাধ্যমেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেকেই সেসব বিষয় ততটা আমলে নিই না। এতে আমরাই সম্মুখীন হই নানা সমস্যার। এবং এই বর্জ্য আমাদেরই গলার কাঁটা হয়ে যায়।
তবে আমরা সচেতন হয়ে কোরবানির বর্জ্যকে যদি সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনি, তাহলে পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত, জনস্বাস্থ্য থাকবে নিরাপদ এবং জবাই করা পশুর উচ্ছিষ্টাংশসমূহও সম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে। কোরবানির সময় যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হবে তা শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ঘাড়ে চাপালেই চলবে না। ব্যক্তিপর্যায়েও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্জ্য অপসারণে প্রধান একটি উপায় হলো কোরবানির আগেই বাড়ির পাশে কোনো মাঠে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা। কোরবানির পর পশুর বর্জ্য সেখানে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া।
তবে শহরাঞ্চলে গোবর ও উচ্ছিষ্ট আলাদা করে খোলাভাবে না ফেলে সেগুলো ব্যাগে ভরে নির্ধারিত স্থান যেমন নিকটস্থ ডাস্টবিন বা কন্টেইনারে ফেলা—যাতে সেখান থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বর্জ্য সহজেই সরিয়ে নিতে পারেন। পশু জবাইয়ের স্থানে পশুর রক্ত জীবাণুনাশক পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়ে ব্লিচিং ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে করে দুর্গন্ধ না ছড়ায় বা জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পাড়তে না পারে। কোরবানির বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তার একটি উপায় হলো গ্রামাঞ্চলে অনেকের পশু একত্রে কোরবানি করা এবং পশুর বর্জ্য মাটির নিচে পুঁতে রাখা, যা পরবর্তী বছর কোরবানির আগেই জৈব সার হিসেবে শস্যক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যায়। এছাড়াও পশু হাড় থেকে শুরু করে শিং, নাড়ি-ভুড়ি, মূত্রথলি, চর্বি ইত্যাদি সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা এবং আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া। এতে একদিকে পরিবেশ উন্নত হবে, অন্যদিকে সম্ভব হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও।
শহরে বসবাসকারীরা বিচ্ছিন্ন স্থানে কোরবানি না দিয়ে কয়েকজন মিলে এক জায়গায় কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ করতে সুবিধা হবে। তবে খেয়াল রাখা উচিত, কোরবানির জায়গাটি যেন খোলামেলা হয় এবং সহজেই বর্জ্য অপসারণ করা যায়। জায়গাটি রাস্তার কাছাকাছি হলে বর্জ্য অপসারণের গাড়ি পৌঁছানো সহজ হবে। পশুর বর্জ্য পলিথিনের ব্যাগে ভালো করে রশি দিয়ে বেঁধে সংরক্ষণ করতে হবে যেন কুকুর, বিড়াল সেগুলো যেখানে সেখানে নিয়ে ফেলতে না পারে। যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেসব স্হানের বর্জ্য ব্যাগ বা বস্তায় ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখা উচিত।
করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। তাই কোরবানিতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরি। পশু জবাইয়ের পরে বর্জ্য দ্রুত পরিষ্কার ও চামড়া ব্যবস্হাপনায় যেন কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ