এ দেশের মানুষের কাছে কোরবানির ঈদ হচ্ছে সর্বজনীন উত্সব। এই ধর্মীয় উৎসবে ত্যাগের মহিমাই মুখ্য। এর মেরুকরণ ধনী-নির্ধন সবার মধ্যে দেখা দেয়। কেননা কোরবানির মাংস সামাজিকভাবে ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বণ্টিত হয়ে থাকে। ফলে কল্যাণমুখী অর্থনীতিতে কোরবানির ঈদ প্রভাব রেখে থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে গবাদি পশুর যে খামার তৈরি হচ্ছে, তাতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছি। কিন্তু গবাদি পশু লালনপালনের ক্ষেত্রে আমরা কাঙ্ক্ষিত হারে আধুনিকতা আনতে সক্ষম হইনি। ফলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে গবাদি পশু লালনপালন করা হয়।
যদি নিউজিল্যান্ড থেকে টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে গবাদি পশু লালনপালনের উন্নততর ব্যবস্থা এ দেশের খামারিরা ব্যবহার করত, তবে গবাদি পশুর লালন পালনে যেমন কম খরচ পড়ত তেমনি ক্রেতাসাধারণও স্বস্তির মাধ্যমে কোরবানির জন্য গবাদি পশু ক্রয় করতে পারত। এ বছর কোরবানির জন্য ১ দশমিক ২১ কোটি কোরবানির পশু প্রস্ত্তত করা হয়েছে। গবাদি পশুবাহী ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহন যাতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গবাদি পশুর ন্যাঘ্য দাম পেলে খামারিরা উপকৃত হন। পাশাপাশি খামারিদের উচিত আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সৃজনশীলতার সঙ্গে স্বল্পমূল্যে গবাদি পশু লালন পালনে ব্রতী হওয়া।
এদিকে কোরবানিকে ঘিরে যে ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে যারা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার তারা উপকৃত হয়ে থাকেন। দেশে যে ছদ্মবেশী বেকারত্ব আছে, তাদের মধ্যে কোরবানির সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। রাখাল থেকে শুরু করে গরু লালনপালন এবং এমনকি সেমি কসাইয়ের কাজও ছদ্মবেশী বেকাররা করে থাকেন। এতে তাদের কিছুটা হলেও আয়-রোজগার হয়ে থাকে। আবার এক-তৃতীয়াংশ জবেহকৃত পশুর গোশত গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এদেশে মোট সারা বছর যে পরিমাণ গবাদি পশু জবাই হয় তার ৮০ শতাংশ কোরবানির সময়ে জবাই হয়। চাটাই থেকে শুরু করে ছুরি কাচি, গাছের গুঁড়ি, খড়-খইল, ঘাস ইত্যাদির বিক্রি বাড়ে এসময়। এবছর প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন অর্থ মূল্যের কোরবানির পশুর লেনদেন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গ্রামীণ অঞ্চলে গবাদি পশু লালন পালনের জন্য যে সমস্ত খামার অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে তৈরি হয়েছে সেখান শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্হানে সৃষ্টি হচ্ছে। এটি কোরবানির অর্থনীতির ইতিবাচক দিক। কেননা সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধির জন্য কর্মসংস্হানের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
গবাদি পশু লালন-পালনের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অতীব জরুরি। ইসলামিক আইন অনুযায়ী কোরবানির পশুর চামড়ার অর্থমূল্যের হকদার হচ্ছেন গরিব মানুষেরা। যাতে এ চামড়ার ন্যাঘ্যমূল্যের প্রাপ্তি ঘটে, তার জন্য তিনটি কাজ করা প্রয়োজন। যারা গবাদি পশুর দেহ থেকে চামড়া ছাড়াবেন তারা যেন যত্ন সহকারে কাজটি করেন। চামড়া সংরক্ষণ পদ্ধতি যাতে যথাযথ হয়, সেদিকে যারা মৌসুমিভিত্তিক চামড়া ক্রয় করেন, তাদের তা খেয়াল রাখা উচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়া নিয়ে লোক ঠকানোর যে ব্যবসা হয়, সেটি অগ্রহণযোগ্য। কোনো ধরনের সিন্ডিকেট যেন চামড়ার ন্যাঘ্যমূল্য থেকে কাউকে বঞ্চিত না করে। গরিব মানুষের হক মেরে যারা চামড়ার মূল্য নিয়ে কার্টেল বা সিন্ডিকেট করে গত ঈদুল আজহার মৌসুমে গরিব মানুষকে বঞ্চিত করেছে, তারা আল্লাহর দরবারে দায়ী থাকবেন। আশা করা যায়, এ বছর কোরবানির চামড়া নিয়ে দুষ্টচক্র কোনো ধরনের অযাচিত সিন্ডিকেট গড়ে তুলে আবার গরিবের হক মারার ব্যবস্হা করবেন না। অথচ এ দেশের গবাদি পশুর চামড়া অত্যন্ত উন্নতমানের বলে বিশ্বে সমাদৃত। এজন্য কেবল সরকারি হস্তক্ষেপই নয়, বরং ব্যক্তিপর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে অপরকে না ঠকানো ও হালাল রুজির প্রতি মধ্যস্বত্বভোগীদের সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। কোরবানির সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শহরের মানুষেরা গ্রামীণ অঞ্চলে যায়। ফলে এ সময়েও গ্রামীণ অঞ্চলের অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে থাকে। গত দুই বছর করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে ঘাত-প্রতিঘাত ছিল, এবার সে ধরনের বাধ্যবাধ্যকতা না থাকায় গ্রামের মেহনতি মানুষ লাভবান হবেন। তাদের কষ্টার্জিত শ্রমে কিছুটা হলেও অর্থমূল্য দৈনিক মজুরি হিসাবে বৃদ্ধি পায়। শহর থেকে গ্রামে মানুষ নাড়ির টানে ছুটে যাচ্ছেন গ্রামে। এতে গ্রামে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে। মানুষের যাতায়াতের জন্য পরিবহন খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে। গ্রামে যাওয়ায় একে অন্যের বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত হচ্ছে। অন্যদিকে করোনার জন্যে ঘর বন্দি থাকতে থাকতে মানুষের মধ্যে যে মতোবৈকল্য দেখা দিয়েছিল, স্বাভাবিক অবস্হায় তা ভালোর দিকে ফিরতে শুরু করেছে।
কোরবানির ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরে বেড়ান। এতে পর্যটনশিল্পে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। পর্যটনশিল্পের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঈদের রয়েছে ইতিবাচক প্রভাব। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় কোরবানির ঈদের সময় যে আর্থিক লেনদেন হয়, তা পেশাদারিত্বমূলক হলে মোট দেশজ উত্পাদনে এর ২ শতাংশ সংযুক্তি ঘটবে। কোরবানির ঈদ দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহাঘ্য করে থাকে। কোরবানির ঈদে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনয়ন করে দেশের অর্থনীতিকে তা আরো সমৃদ্ধ ও বলশালী করে। ঈদ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালনের পাশাপাশি এর আর্থিক ব্যবস্হাপনাকে আরো এগিয়ে নিতে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও আইটি বিশেষজ্ঞ সাবেক উপাচার্য, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা