শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

শোক আর যন্ত্রণার স্মৃতির পসরা সাজিয়ে এলো আগস্ট

আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৩, ২১:৫৯

সমাজে মানুষ অপয়া হয়। অলক্ষুনে হয়। ছোটবেলায় শুনতাম সপ্তাহের দু’একটা দিনও অপয়া হয়। তার মধ্যে শনিবার, মঙ্গলবার, বুধবার উল্লেখযোগ্য। শনিবারে সাবধানে থাকতে হয়, নাহলে শনি লাগতে পারে। সন্ধ্যার পর মঙ্গলবার বাইরে থাকা ভালো না। মঙ্গলবার নাকি ভূত-প্রেতের বার। এদিন তারা মানুষ, কুকুরসহ নানা প্রাণীর বেশ নিয়ে চলাফেরা করে। সফর, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বুধবার মন্দ দিন। 

এইদিনে কোনো শুভকাজ শুরু করতে নেই, শুভযাত্রাও করতে নেই। এমনকি এই দিনগুলোতে মানুষকে ছোটবেলায় বিয়ে করা থেকেও দূরে থাকতে দেখেছি। ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কল্প-কাহিনী। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে সেসব কাহিনী আজ কৌতুকের বিরাট খোরাক যোগায়। তবে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অনুধাবন করেছি, ব্রিটিশ শাসনের দিয়ে যাওয়া ইংরেজি ১২ মাসের একটি মাস সত্যি অপয়া। অন্তত বাঙালি জাতির জন্য। নইলে এই দিন এলেই কেন সকল পত্রিকা-টেলিভিশনে শিরোনাম হয় ‘এলো শোকের মাস আগস্ট’? হিসেব করে দেখলাম, কথা মিথ্যে নয়। 

বাঙালির জীবনে আগস্ট অনেক হারানোর বেদনা নিয়ে আসে। অনেক শোক আর যন্ত্রণার স্মৃতির পসরা সাজিয়ে আসে আগস্ট। শুরু করা যেতে পারে ৫ই আগস্ট হারিয়েছি সিকান্দার আবু জাফরকে। তিনি একজন বাঙালি কবি, সঙ্গীত রচয়িতা, নাট্যকার ও সাংবাদিক। তিনি অখণ্ড ভারতে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা সমকাল সম্পাদনার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হলো জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই। এটি পরে জনপ্রিয় গণসংগীতে রূপান্তরিত হয়। ৬ আগস্ট চিরবিদায় নেন সুরেন্দ্র ব্যানার্জী। সুরেন্দ্র ব্যানার্জী ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুগের একজন বিশিষ্টনেতা। তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা। পরে এ দলটিকে নিয়ে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তাঁকে রাষ্ট্রগুরু সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। ৭ আগস্ট, এই দিনে বাংলা ও বাঙালির বিস্ময়পুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। যে কবি তার সাহিত্যের আলোতে আলোকিত করে গেছেন হাজার বছরের বাঙালির মন ও মননশীলতা, সেই কবির চলে যাওয়া দিন এই আগস্টের ৭ তারিখ। বলা বাহুল্য, এপার-ওপার দুই বাংলাতেই চলে রবি ঠাকুরের স্মরণে শোকের মাতম, শ্রদ্ধাঞ্জলির মহড়া। 

অকুতোভয় ক্ষুদিরাম বসুকে ১১ আগস্ট ভোরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। আবার এই ১১ আগস্টের এই দিনে একদল ধর্মান্ধ, ভীরু, কাপুরুষের জঘন্য হামলায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আরেক শক্তিমান লেখক হুমায়ুন আজাদ। তিনি থাকলে জাতির কতটা উপকার হতো জানিনা, তবে তার না থাকা জুড়ে যে কত শূন্যতার জন্ম হয়েছে তা সচেতন আর মুক্তমনা বাঙালি মাত্রই উপলব্ধি করছে।

১১ তারিখের ক্ষত শেষ না হতেই সামনে এসে দাঁড়াবে আরেক শোকের দিন ১৩ আগস্ট। এই দিনে নতুন সিনেমার জন্যলোকেশন দেখতে গিয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নন্দিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। তার সঙ্গে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক মিশুক মনির। দুই দিগন্তের এই দুই দিকপালের মৃত্যুবার্ষিকী মানেই বাংলাদেশিদের জন্য যন্ত্রণাময় স্মৃতির দিন।

প্রতি বছর আগস্ট মাস এলেই প্রগতিশীল, স্বাধীনতা বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালির মনে নানা ঘটনা ঘুরপাক খায়। স্বাধীন বাংলাদেশে এ মাসে নেমে আসে বাঙালি জাতির ওপর এক কালো থাবা। বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কিত এক অধ্যায় সূচিত হয়েছে এই আগস্ট মাসে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি জাতি সে নিষ্ঠুর হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হলেও ঘাতকদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে এ মাস। আগস্টকে ঘাতকরা তাদের নিষ্ঠুর টার্গেটের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছে বারবার আর ১৫ আগস্টের পরিচয় বাঙালিকে নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। এদিনে ক্ষমতালোভী কিছু পাষণ্ড, বর্বর, অসভ্য, জানোয়ার সেনা অফিসারের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিবছরের এই দিনটি বাংলাদেশের জন্য জাতীয় শোকের দিন। ইতিহাসে এমন ভয়াবহ কলঙ্কিত ইতিহাসের দিন আর কখনো আসেনি, বোধ হয় আর আসবেও না। ১৫ আগস্টের ভোররাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হারানোর ক্ষতি আজীবন এই জাতিকে বহন করতে হবে।

১৭ আগস্ট নাগরিক কবি শামসুর রাহমানকে হারিয়েছি। শামসুর রাহমান বিংশ শতকের ত্রিশ দশকের পাঁচ শ্রেষ্ঠ কবির পর আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আদি নিবাস নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে চলে যান। সেখানে যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনাবিধুর হয়ে ‘স্বাধীনতা তুমি এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যহে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি লেখেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি বার বার তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে খুনিরা ধারালো অস্ত্রসহ তার বাসায় হামলা করে। ১৭ আগস্ট তার মৃত্যুবার্ষিকী। নিঃসন্দেহে বরাবরের মত এবারেও এই দিনটি খুঁচিয়ে যাবে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনাকে। তৎকালীন ১৮ দলীয় জোট সরকার আমলে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল ভণ্ড কিছু ধর্মান্ধ জঙ্গি সন্ত্রাসী। এই হামলায় ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। তবে তার চাইতেও বড় ক্ষতিটা হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশের জন্য এর চাইতে অলক্ষুণে, অপয়া আর কোন দিন হতে পারে?

এই মাসের হারানোর ইতিহাস বড়ই অদ্ভুত তাই এই মাসে আমরা হারিয়েছি আমাদের নাটকের দুই দিকপালকে ১৮ তারিখে সেলিম আল দ্বীন। তবে এই দিনটি আরও বেদনাময় হয়ে উঠে ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় নেতাজী সুভাষ বসুকে বহনকারী বিমান তাইপেতে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে ভারতের বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষ বসুর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়। নেতাজীর মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহরে অসংখ্যবোমা নিক্ষেপ করে হাজার হাজার জাপানির মৃত্যু ঘটায়। আগস্ট মাসের এ ঘটনা জাপানিদের কাছে ভয়াবহ স্মৃতির ইতিহাস। ২০ আগস্ট আমরা হারিয়েছি আমাদের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে। ২১ তারিখে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। এতো সব পেরিয়েই আসে ২১ আগস্ট! তৎকালীন জোট সরকারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাসীরা ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলীয়নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন। 

হাসপাতালে নিহত হওয়া সেই ১২ জনের একজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নারী নেত্রী মিসেস আইভী রহমান। যিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। একজন নির্লোভ, সাহসী, সৎ নেত্রী হিসেবে আইভি রহমানের মৃত্যু দিবস ২৪ আগস্ট আরেকটি শোকের দিন। অবশ্য তারও আগে এই দিন বাঙালির কাছে অপয়া হয়ে আছে ইয়াসমীন হত্যার দিন হিসেবে। 

১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে একদল পুলিশ সদস্যের হাতে তরুণী ইয়াসমিন নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের আমজনতা। প্রতিবাদী মানুষকে লক্ষ্য করে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সাতজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। সবশেষে একেবারে মাসটির শেষের দিকে লেগে আছে আরেক শোকের দাগ। তা হলো ২৮শে আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনের শোক নিয়ে কিছু বলব না। কেবল হৃদয়ের বেদনা ভাগ করে নিতে চাইব একটা অভিমত দিয়ে। বাঙালি হয়ত আর কোনো দিনই নজরুলের মত মহামানবের দেখা পাবে না। আগস্ট বোধ হয় তার অপয়া স্বভাব থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না। তবুও আশা থাকবে আগস্ট বাঙালির জন্য আর কোনো বেদনার খবর দিবে না আমাদের।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

ইত্তেফাক/পিও
 
unib