সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তঃসর্ম্পক

আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:২৫

প্রাথমিক শিক্ষা যে কোনো দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ধাপ। এই ধাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। যদি এই ভিত্তিকে মজবুত করে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যে কোনো শিক্ষা প্রকৃত অর্থে কার্যকরী হয় না। একটা সময় ছিল স্কুলে যেতে অনেক পথ পায়ে হাঁটতে হতো। দুপুর গড়িয়ে গেলে মা পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতো- খোকা এখনও আসছে না, খুব কষ্ট হয় খোকার। অনেক মমতায়—আদরে লালিত খোকার ফিরে আসা অব্দি মা দুপুরের খাবার খেতেন না। খোকা এলে তবেই মা খোকাকে খাইয়ে নিজে খেতেন। বাবা নামের কঠিন মানুষটিও কষ্টে অর্জিত টাকায় খোকার জন্য নতুন জুতো জামা এনে রেখে দিতেন। খোকা ফিরলে লুকিয়ে দেখতেন খোকার উত্তেজনা আর সারা বাড়ি মাথায় তোলার সে কি আনন্দ! বর্তমান সরকারের বদান্যতায় প্রাথমিক শিক্ষায় যুগান্তর ঘটেছে। আজ আর স্কুল দূরে নয়, বাড়ি থেকে খানিক দূরেই একাধিক স্কুল। তাই সেই আনন্দ-বেদনাগুলোর ধরণ পাল্টে গেছে। 

নবজাতকরা পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকে শিখতে শুরু করলেও ৪-৫ বছর বয়সে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। শিশুরা বৈচিত্র্যময় পৃথিবী সম্পর্কে বুঝতে শেখে শিক্ষকদের কাছে। শিক্ষকই জ্ঞানশূন্য মানবশিশুকে ভিন্ন চোখে বিশ্ব দেখতে শেখায় এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। শিশুমনের খালি ক্যানভাসে রঙিন দুনিয়ার প্রথম আঁচড় আঁকেন শিক্ষকের তুলি। তাই শিশুদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক অত্যন্ত সম্মানসূচক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে এখন শিক্ষাক্ষেত্রে টপ-ডাউন বা নিম্নমুখী পদ্ধতি পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে যেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আরও সহজ হয় এবং এটি যেন একজন শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসু মনকে জাগ্রত করতে সহায়ক হতে পারে। গত কয়েক বছর মাঠপ্রশাসনে কাজ করার অপূর্ব এক সুযোগ হয়েছে আমার। মানিকগঞ্জ জেলার ভাষা শহিদ রফিকের জন্মঋণে ঋণী ছায়াশীতল সিংগাইর উপজেলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে নানামুখী কাজ করলেও আমার মূল ফোকাস ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তঃসংযোগ তৈরি করা।

শিশুমনস্তত্ত্ব জানা সুশিক্ষিত মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হওয়া প্রয়োজন। সময়ের পথ ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের মধ্যেও নানান রঙ যুক্ত হয়েছে, বা কিছু ক্ষেত্রে বিযুক্ত হয়েছে। তবে যেভাবেই ভাবা হোক না কেন, আমাদের জীবনে বাবা-মার পরেই যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে থাকেন শিক্ষকবৃন্দ, তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যেন খুব সহজেই তার যেকোনো সমস্যা এবং কোনো বিষয়ের ওপর মতামত শিক্ষককে বলতে পারে। একইভাবে, শিক্ষার্থীকেও একজন শিক্ষকের মতামত, অনুশাসন এবং উপদেশ শুনতে হবে, যদি সেটি সাময়িকভাবে তার মতের বিরুদ্ধেও যায়। শিক্ষার্থীরা সবসময়ই এমন একজন শিক্ষক চায় যিনি তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন, আত্মবিশ্বাস যোগান, উৎসাহিত করেন। তিনি একটি ইতিবাচক পরিবেশে একজন শিক্ষার্থীকে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করেন, তাকে বুঝাতে শেখান কীভাবে নিজের যোগ্যতার সেরা চেষ্টাটুকু করতে হয়।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা পদক বাছাই কমিটির সভাপতি হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন শিক্ষকের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সাক্ষাৎকারকালে অধিকাংশ শিক্ষকই বলেছেন, তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মনে করেন কারণ তিনি অন্য যে কারোর চেয়ে ভালো শিক্ষকতা করেন, তার পড়ানোর ধরণ অন্য শিক্ষকের চেয়ে আলাদা। তবে একজন শিক্ষক বলেন, তার শিক্ষার্থীরা তাকে খুব পছন্দ করে। তিনি কোনো কারণে স্কুলে না আসতে পারলে শিক্ষার্থীরা মন খারাপ করে। তিনি পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীরা আনন্দ পায়। তারা একসাথে হাসেন। বিষয়টি আমাকে নাড়া দেয়। পরবর্তীতে সেই স্কুলে পরিদর্শনে গিয়ে দেখি, ঐ স্কুলের ফলাফল ভালো এবং স্কুল ঝড়ে পড়ার হারও কম। সহজেই অনুমেয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তঃসম্পর্কের রয়েছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী শেখানোর কৌশলে শিক্ষকদের অভিনবত্ব আনতে হবে। একজন শিক্ষককে সময়ের সাথে সাথে তার শেখানোর কৌশল অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে এবং এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন দক্ষতায় তিনি সবসময় নিজেকে আরো উন্নত করবেন। এতে শিক্ষার্থীও তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে পারবে এবং নতুন কিছু শেখার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে। নতুন কিছু ভাবতে শিখবে, হারিয়ে যাবে সুন্দর কল্পনার জগতে। একজন শিক্ষককে শুধু বই পড়ালেই হবে না। বইয়ের বাইরের জ্ঞানও অর্জন করাতে হবে। বইয়ের আলোচনা থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেতে হবে বিশ্বভ্রমণে। আর এজন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে কিংবা একাডেমিক কাজ ছাড়াও কথা বলার সময় দিতে হবে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সময় দেন শিক্ষার্থীরা ভালো হয়ে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাকে অন্যভাবে বললে, শিক্ষকদের দেয়াল ডিঙাতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দেয়াল রয়েছে, তা বাদ দিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ভাব বিনিময়ের বিষয়টি বাড়াতে হবে। কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে যেন সংকোচ না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বরং, শিক্ষকদের গল্প বলতে বা এমন উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত যা শিক্ষার্থীদের কল্পনাপ্রসূত মনে সহজেই দাগ টানতে পারে এবং উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে ভিত্তি রচনা করতে পারে।

একজন শিক্ষকের সুসংহত চিন্তা করা আবশ্যক। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষককে কিছু বলার পূর্বে অবশ্যই তার চিন্তাগুলো সুসংগঠিত ও পরিষ্কার হতে হবে কারণ তিনি যাই বলছেন, সেটির প্রভাব তার শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে। শিক্ষার্থীরা এমন একজন শিক্ষকের প্রশংসা করেন যিনি স্বীকার করেন যে, তিনি সবকিছু জানেন না এবং যিনি শিক্ষার্থীদের মতামত বা মতবিরোধ শুনতে ইচ্ছুক হন। একজন শিক্ষকের নিজের ভুল স্বীকার করার মতো মানসিকতা থাকা উচিত। এ-ধরনের মানসিকতার শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন। একজন শিক্ষক পড়াশোনার পাশাপাশি বর্তমান সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করতে পারেন। এতে করে শিক্ষার্থীরা নৈতিক গুণাবলীর প্রতি সচেতন হবে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সততা, বিবেকবোধ, সৎসাহস— এ-ধরনের নৈতিক গুণাবলির বিকল্প নেই। আমি মনে করি, এই জায়গাটিতে একজন শিক্ষকের চাইতে বেশি অবদান কেউ রাখতে পারবেন না।

আলোচনার শুরুতে যেমনটা বলছিলাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ প্রকৃত অর্থে বাবা-মায়ের দায়িত্বই পালন করেন। আমি কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করছিলাম, এতো ছোটো শিশুরা যে স্কুলে আসে, তারা যদি স্কুলে পটি করে তখন আপনারা কি করেন? বিরক্ত হন? এতটুকু সংকোচ না রেখে বেশ কয়েকজন শিক্ষক খুব মমতার সঙ্গে বলেছেন, তারা নিজেরাই পরিষ্কার করেন। বিষয়টি অবিভূত হওয়ার মতো। বাচ্চাগুলো মাঝে মাঝেই উদ্ভট কিছু প্রশ্ন করে থাকে। এ বিষয়ে কি করেন জানতে চাইলে অনেকে বলেন, বিষয়টিকে তারা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। এমনভাবে প্রশ্ন শুনেন এবং উত্তর দেন যেন ঐ শিক্ষার্থী ভাবে যে তার প্রশ্নটি খুব চমৎকার, সে যেন কোনোভাবেই অসম্মানিত না হয়, যেন প্রশ্ন করতে ভয় না পায়, দমে না যায়। এমনটাই হওয়া উচিৎ শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্তঃসম্পর্ক।

সবশেষে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়ে উঠুক, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন ও মন আলোকিত হয়ে উঠুক জ্ঞানের আলোয়, সকল শিক্ষকই হোক শিক্ষার্থীর চোখে প্রিয় শিক্ষক—এ প্রত্যাশায় লেখাটি শেষ করছি।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ

ইত্তেফাক/পিও