মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

গল্প

লোকমান সাহেবের টকশো

আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:৩০

শামুকের মতো কম্ফোর্টারের খোল থেকে মাথা বের করে তাকালেন লোকমান সাহেব। ফোনটা না বাজলে তিনি আরো কিছুক্ষণ কম্ফোর্টারের ওমে নিজেকে বস্তাবন্দি করে রাখতেন। ফোনটা বেজে থেমে গিয়েছিল। আবার বেজে উঠল। মোবাইলটা হাতে নিলেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব গোলাম মওলার ফোন। ওপাশ থেকে গোলাম মওলার তেজি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো—‘কী হলো লোকমান, সকালের আড্ডাতে তোমাকে দেখা গেল না যে?’

‘দোস্ত, কাল ব্লাডপ্রেসারটা বেশ হাই ছিল। ঘুমের ব্যঘাত হয়েছে। তাই সকালে বের হলাম না।’ লোকমান সাহেব জানালেন।

‘আড্ডাটা কিন্তু দারুণ জমেছিল। আমরা নলেন গুড় দিয়ে চা খেলাম, সঙ্গে পটিসাপটা পিঠা। খুব মিস করেছ তুমি। যাই হোক মানববন্ধনে আসছ তো? প্রেসক্লাবের সামনে, সকাল এগারোটায়। চলে এসো।’

কুয়াশা ফুঁড়ে এক ঝলক রোদ জানালা গলিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরের ভিতর। রোদের নরম আঁচ গড়াগড়ি দিচ্ছে বিছানায়। জানালার ওপাশে সাদা করবীর থোকাটা বাতাসে দোল খাচ্ছে অল্প অল্প। রেলিংয়ে বসে লাফালাফি করছে দুটো চড়ুই, তাদের ডাকাডাকিতে সরগরম হয়ে উঠেছে গোটা বারান্দা। লোকমান সাহেব অলস চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল সাড়ে আটটা। বিছানা থেকে নামলেন তিনি। তার সাড়া পেয়ে দরজায় বাবুর্চি মতি দেখা দিল। মতির হাতের ট্রে থেকে ধোঁয়া উগরাচ্ছে গরম চায়ের কাপ।

নাস্তার টেবিলে বসতে না বসতেই ফোন এলো একটি টিভি চ্যানেল থেকে। প্রোগ্রাম প্রডিউসার হামিদ আকন্দের কল—‘স্যার ভালো আছেন?’

‘ভালো আছি। তবে ব্লাডপ্রেসারটা একটু ভোগাচ্ছে।’

‘অসুখটা খুব ভোগায় স্যার। আমি নিজেই তো ভুগছি। মাঝে মাঝে পারদ দুশো পর্যন্ত উঠে যায়। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন তো? আমার পরিচিত একজন ভালো মেডিসিনের ডাক্তার আছে, তার সাথে একটা অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে দেব?’

লোকমান সাহেব প্রসঙ্গ পালটালেন। চামচে গরম চায়ের কাপে স্টেভিয়া কিউব নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘হামিদ, ফোন করেছ কেন বলো।’

‘স্যার, আগামী পরশু সন্ধ্যায় আমাদের চ্যানেলের টকশোতে আপনি প্রধান আলোচক হিসাবে থাকবেন বলেছিলেন। অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ছ’টা চল্লিশ মিনিটে শুরু হবে।’

কী যেন ছিল টকশোর বিষয়—একটু চিন্তা করলেন লোকমান সাহেব। তারপর উত্ফুল্ল গলায় বলে উঠলেন, ‘ও হ্যাঁ, কিশোর অপরাধ নিয়ে কথাবার্তা হবে। খুব ইনটারেস্টিং টপিক। আমি থাকব। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’

মতি টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। লোকমান সাহেব অমলেটের উপর গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটাতে ছিটাতে মতির দিকে তাকালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রবিন ব্রেকফাস্ট করেছে রে মতি?’

‘জি না। ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে দেরি করে ফিরেছে তো। বলেছে উঠতে দেরি হবে।’

মতির কথায় একটু যেন উদ্বিগ্ন হলেন লোকমান সাহেব। অধ্যাপনা, বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী সমাবেশ, টকশো, সেমিনার সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি সারাক্ষণ এত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন যে ছেলেকে দু-দণ্ড সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্ত্রী মরিয়মই ছেলের দেখভাল করে থাকেন। আজ মাস ছয়েক হলো মরিয়ম কানাডায় মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন। মেয়ে অরিন সন্তানসম্ভবা। মরিয়মের ফিরতে আরো কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তাই ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় আছেন লোকমান সাহেব।

সেই রাতে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান শেষে লোকমান সাহেব বাড়ি ফিরেছেন। বেশ খেটেখুটে কিশোর গ্যাং আর কিশোর অপরাধ বিষয়ে বিস্তর তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেছিলেন। সকলের অগোচরে কিশোর অপরাধটা সংক্রামক ব্যাধির মতো কীভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে—অনুষ্ঠানের ফোকাস ছিল সেখানে। অনুষ্ঠানটি বিপথগামী কিশোর, তাদের অভিভাবক আর নীতিনির্ধারকদের যে যথেষ্ট চিন্তার খোরাক জোগাবে—এতে সন্দেহ নাই। উপস্থাপনাও ছিল চমত্কার। ইতিমধ্যে বন্ধু এবং বুদ্ধিজীবী মহল থেকে বেশ ক’টি অ্যাপ্রিশিয়েশন বার্তা পেয়ে গেছেন। এসব কারণে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন লোকমান সাহেব।

বারান্দায় এক কাপ চা নিয়ে আয়েশ করে মাত্রই বসেছেন, মোবাইলটা বেজে উঠল। নম্বরটা অচেনা। লোকমান সাহেব ফোন তুললেন। কথা বলে উঠল একজন, ‘স্যার, আমি উত্তরা থানা থেকে ওসি বলছি। আজ সন্ধ্যায় সেক্টর বারো এলাকায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। দুর্ঘটনা সম্পর্কে আপনাকে জানানো দরকার।’

‘কী রকম দুর্ঘটনা?’

‘দুটি কিশোর গ্যাংয়ের মারামারি বেধেছিল। একজন রিকশাওয়ালা গুলি খেয়ে মারা গেছে।’

‘বখে যাওয়া ধনীর দুলালদের জন্য এই অবস্থা। এই গেল সপ্তাহেই তো এক বড়লোকের ছেলে রেসিং করতে গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন পথচারীর উপর গাড়ি তুলে দিয়েছে। কী দুঃখজনক ব্যাপার বলেন তো। ওসি সাহেব, খবরটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। আহা গরিব রিকশাওয়ালা বেচারা!’ লোকমান সাহেবের গলায় আক্ষেপের সুর।

‘সত্যি দুঃখজনক স্যার’, ফোনের ওপাশ থেকে ওসি বললেন, ‘তবে ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমরা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে সাতজন ইয়াংস্টারকে ধরে এনেছি।’

‘খুব ভালো করেছেন। এদের অনেক বাড় বেড়েছে। শিক্ষা হওয়া দরকার। একটা কঠিন অভিযোগপত্র তৈরি করবেন যাতে এই অপরাধীরা ছাড়া না পায়। এদের অভিভাবকদেরও একটু শিক্ষা হওয়া দরকার।’ লোকমান সাহেব জোর গলায় বললেন।

‘স্যার, আপনাকে একটু থানায় আসতে হবে।’

‘আমাকে আবার থানায় আসতে হবে কেন?’ ওসির কথায় বেশ অবাক হলেন তিনি।

‘আমরা যে ছেলেগুলোকে ধরে এনেছি, তাদের মধ্যে আপনার ছেলে রবিনও রয়েছে।’

‘আমার ছেলে রবিন? আপনি ঠিক বলছেন তো?’ লোকমান সাহেবের বিস্ময় কাটে না।

‘জি স্যার। গুলি খেয়ে যে রিকশাওয়ালাটা মারা গেছে, সেই গুলিটা করেছে রবিন।’

‘রবিন গুলি করেছে? কী বলছেন এসব?’

‘জি স্যার। গুলিটা কিন্তু আপনার পিস্তল থেকে ছোড়া হয়েছে।’

ওসির কথায় এবার আঁতকে উঠলেন লোকমান সাহেব। মনে হলো তাকে ঘিরে একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল। ফোনটা টিপয়ের ওপর রেখে তিনি শ্লথ পায়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। দেওয়াল আলমারির পাল্লা খুলে কাঁপা কাঁপা হতে ড্রয়ার টেনে বার করে ভেতরে তাকালেন। তার চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠেছে। ড্রয়ারটা ফাঁকা। তার লাইসেন্স করা পিস্তলটা এই ড্রয়ারেই থাকে। পিস্তলটা নেই।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন