শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাত-প্রজাতির ভেদ-প্রভেদ

আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২১, ১০:০৬

জাতপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে ভেদ-প্রভেদ সৃষ্টি করেছে মানুষ সেই কবে থেকেই। সদ্য জন্মগ্রহণ করা শিশুর কোনো জাতপাত নেই। জগত্সংসারে মনুষ্যসৃষ্ট বিভেদে পড়ে শিশু যত বেড়ে ওঠে তত বুঝতে পারে যে, কোনো না কোনো একটি জাতপাতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সে। উঁচু জাত, নিচু জাত, অভিজাত, এমনি কত রকম ভেদ-বিভেদ সৃষ্টি করা জাত রয়েছে মানুষের মধ্যে। হিন্দু সমাজে জাতপাত তো এক ভীষণ বিভেদমূলক প্রথায় পরিণত হয়েছে। চোখের সামনেই দেখছি শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চাও সে বিভেদ ঘোচাতে পারছে না। আমার দু-তিন বন্ধু তাদের মেয়েদের বিয়েই দিতে পারছে না জাতে মিলছে না বলে। হিন্দু সমাজ একে ‘কাস্ট’ বলছে। তবে নাম যা-ই হোক, সেটি মানুষসৃষ্ট জাতপাতের বিভেদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে বিভেদ অনেক নারীকে সংসারবিহীন করে দিচ্ছে। অতি আধুনিক বিশ্বে সমাজে এরকম জাতপাতের পার্থক্য থাকা কাম্য নয় একেবারেই। তা সত্ত্বেও এসব এখনো যে বিদ্যমান রয়েছে খবরের কাগজ সে সাক্ষ্য দেয় বৈকি।

People Free Brushes - (345 Free Downloads)

কত রকম মানুষ আছে পৃথিবীতে। মানুষের শারীরিক গঠন আর বর্ণবৈচিত্র্যও বিশাল। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের এই যে বৈচিত্র্য, এর পেছনে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে। সে আলোচনায় যাওয়ার লোভ আজ সংবরণ করলাম। শুধু এটুকু বলা অতি জরুরি যে, কালো বলি, ধলো বলি আর শ্যামা বলি কিংবা এসবের নানা মাত্রায় মিশেল বর্ণের মানুষ বলি, সবাই আমরা পৃথিবী জুড়ে এক প্রজাতিরই অন্তর্গত। নাক দেখুন, ঠোঁট দেখুন, চুল দেখুন, কান দেখুন এমনি কত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য রয়েছে মানুষে মানুষে। উচ্চতার পার্থক্যও তো কম নয়। দীর্ঘদেহী, মাঝারিদেহী, খর্বাকৃতির কত রকমের মানুষ রয়েছে দেশে দেশে। বর্ণবৈভব তো রয়েছেই। কেবল কালো বলে কত মানুষকে সইতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট। রবার্ট ফ্লয়েডকে দিনের বেলায় পুলিশের হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে মেরে ফেলার বর্ণবাদী ঘটনা তো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এই সেদিনও। এত যে মানবসৃষ্ট জাত আর বর্ণের প্রভেদ মানুষে মানুষে রয়েছে তা সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিক সত্য এই যে, আমরা সবাই এক প্রজাতিরই সদস্য। পৃথিবীর সব জীবেরই মানুষ চেনার জন্য একটি নাম দিয়ে থাকে। একই জীবের দেশে দেশে ভিন্ন রকম নাম রয়েছে। ফলে এসব স্থানীয় নাম দিয়ে এক স্থানের জীবকে অন্য স্থানে পরিচয় করে দেওয়া সম্ভব নয়। এদের সবার পক্ষে চেনাও সম্ভব নয়। সে কারণেই বিজ্ঞানীরা প্রতিটি ভিন্ন রকম জীবকে দুই পদযুক্ত নাম দেওয়ার কৌশল আবিষ্কার করেছেন। এর প্রথম পদটিকে বলা যায় গণনাম এবং দ্বিতীয় পদটিকে বলা হয় প্রজাতি নাম। এরকম নামকে আমরা বলি জীবের বৈজ্ঞানিক নাম। এই যেমন মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হলো হোমো সেপিয়্যান্স। হোমো হলো গণনাম আর সেপিয়্যান্স হলো প্রজাতি নাম। প্রজাতি বলতে আসলে একদল জীবকে বোঝায়, যাদের সবার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এদের একই শ্রেণিভুক্ত হিসেবে ধরা হয়। বলা বাহুল্য, মানুষের প্রজাতি রয়েছে, তবে মানুষের কোনো জাত নেই। মানুষের সৃষ্ট যে জাতপাত সে আর যা-ই হোক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এর কোনো ভিত্তি নেই। তবে জগতে যে জাত বলেও কিছু আছে সে কথা আমরা জানব এক্ষুনি।

নিয়মিত পত্রিকার পাতা উলটেপালটে দেখা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একাধিক পত্রিকা পাঠের বদৌলতে বিভিন্ন বিষয় দেখার-জানার সুযোগ পাই। এসবের সুবাদেই জাত-প্রজাতি নিয়ে বিভেদ সৃষ্টিকারী একাধিক উপসম্পাদকীয় পত্রিকায় পড়ার সুযোগ আমার ঘটেছে। এর একটি আম নিয়ে, দ্বিতীয়টি ধান নিয়ে এবং তৃতীয়টি দুই বিজ্ঞানীর প্রজাতি সৃষ্টির প্রয়াস নিয়ে। অতিসম্প্রতি আম নিয়ে প্রকাশিত লেখাটি বেশ উপভোগ্য হয়েছে। আমাদের দেশে আমবৈচিত্র্য কম নয়। বর্ণে-গন্ধে-স্বাদে এদের বৈচিত্র্য যেমন রয়েছে, বৈচিত্র্য রয়েছে এদের আকার-আকৃতি আর নামেও। এদের সিংহভাগই সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন রকম আমগাছের মধ্যে পর-পরাগায়ন সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমেই। বাতাস, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি বাহিত পরাগরেণু এক আমগাছ থেকে বয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য আমগাছের ফুলের গর্ভমুণ্ডে সংস্থাপিত হওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়েছে কত কত বৈচিত্র্যময় আম। সেসব প্রাকৃতিক সংকরায়ণ থেকে প্রাপ্ত আমের বীজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে কত বৈচিত্র্য। সে বৈচিত্র্য থেকে মানুষ বাছাই করে নিয়েছে কত রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ আমের জাত। আবার মানুষও সেই প্রাচীনকাল থেকে তো বটেই, এই আধুনিককালে এসেও কৃত্রিম পরাগায়ন করে উদ্ভাবন করেছে নানা রকম আম। এতে বেড়েছে আমের বৈচিত্র্য। এই যে বৈচিত্র্যময় সব আম, প্রজাতি কিন্তু তাদের একটিই। সে প্রজাতির নাম মেঞ্জিফেরা ইন্ডিকা। এই নাম থেকেই বোঝা যায় ইন্ডিয়া তথা ভারতবর্ষে এদের উত্পত্তি ঘটেছে। সে সূত্রে আমাদের দেশেও আমের উত্পত্তির একটি অংশ পড়েছে। সে কারণেই আমের বৈচিত্র্য যেমন ভারতে রয়েছে, সে বৈচিত্র্য আমাদের দেশেও রয়েছে। এই যে বাজারে কত রকমের সব আম এসবই হলো আমের নানা জাত, প্রজাতি নয় এরা কিছুতেই। আমাদের সব রকম জাতের প্রজাতি কিন্তু একটিই।

জনসংখ্যায় পৃথিবীর বৃহৎ ১০ ধর্ম | 832897 | কালের কণ্ঠ | kalerkantho

এদের প্রজাতি এ দেশে একটিই তবে এদের জাত রয়েছে অনেক। আমের যে বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে সেসব ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি নয় বরং সেসব আসলে ভিন্ন ভিন্ন সব জাত। সেসব জাত ভিন্ন ভিন্ন নামে এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে। মানুষই সেসব ভিন্ন সব জাতের নামকরণ করেছে। নানা নামের মধ্য দিয়ে এসব জাতকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার আমরা চেষ্টা করি। জাত হলো প্রজাতির অধীন একদল জীব, যাদের নিজের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য নেই এবং এদের দেখলে অন্য জাত হতে সহজে পৃথক করা যায়। ‘আম্রপালি’ আম জাতের আম দেখে এবং গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন—পাতার বিন্যাস, পাতার আকার-আকৃতি এসব দেখে অন্য জাতের আম যেমন—মোহনভোগ থেকে আলাদা করা যায়। তেমনি এরা একাধিক প্রজাতির অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন সব জাত।

পৃথিবী জুড়ে তিনটি প্রজাতির ধানের আবাদ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে যে ধান প্রজাতির আবাদ হচ্ছে এর বৈজ্ঞানিক নাম ওরাইজা সেটিবা। এর অন্তর্গত জাতসংখ্যা শুধু আমাদের দেশেই একসময় ১০-১২ হাজার ছিল বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। ভারতে ধান একসময় ২৫ হাজার জাত ছিল বলে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন। সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক, ধানের জাত বৈচিত্র্য যে বিশাল সেটি বলাই বাহুল্য। আর কি এক একটি কী চমত্কার নাম এদের। কটকতারা, দুলাভোগ, বিরুই, কাজললতা, বাঁশফুল, বাদশাহভোগ, রাঁধুনীপাগল, দুধসাগর, চন্দ্রহার, বৌসোহাগী, লক্ষ্মীবিলাস, জিংগাশাইল, তিলককাচারী, কনকচুর, গন্ধমালতি, দুধরাজ, টেপিশাইল, মধুমতী ইত্যাদি ধানের তিন মৌসুমের জন্যই রয়েছে হাজার হাজার ভিন্ন জাত। এদের রয়েছে বাহারি বর্ণ, আকারে-আকৃতিতেও ভিন্ন এরা। রয়েছে স্বাদ-গন্ধের ভিন্নতাও। সব মিলিয়ে আশ্চর্য এক বৈচিত্র্যের ভান্ডার রয়েছে আমাদের ধানের জাতের। প্রজাতি কিন্তু একটিই। ধান বা চালের যে বৈচিত্র্য দেখা যায় এরা সবাই এক একটি ভিন্ন জাত। ধানের জাতগুলো আসলে মানুষের নির্বাচনি শক্তি আর ধান জাত উদ্ভাবন কর্মকাণ্ডের এক একটি উদাহরণ। আগের দিনে প্রাকৃতিক সৃষ্ট ভিন্নতা থেকে মানুষ তার পছন্দমতো বাছাই করেছে এলাকাভিত্তিক হাজার হাজার জাত। এসব আসলে কৃষকেরই সৃষ্ট জাত। পরে মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষাকে আর নানা বৈজ্ঞানিক কৌশল অবলম্বন করে নানা রকম ধান জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব আসলে গবেষকদের জাত উন্নয়ন পদ্ধতি প্রয়োগের ফলাফল। একই প্রজাতির ধানের এরা ভিন্ন ভিন্ন এক একটি জাত। জাত আসলে প্রজাতির অধীন এক রকম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদসমষ্টি। ভিন্ন জাতের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তাই দিয়ে এদের একটি জাতকে অন্য জাত থেকে আলাদা করা যায়। এক প্রজাতির ধানের এরা ভিন্ন ভিন্ন সব জাত।

মানুষ জাত উদ্ভাবন করতে পারলেও প্রজাতি সৃষ্টি মানুষের কাজ নয়। প্রজাতি সৃষ্টি হয় শত-সহস্র বছর ধরে প্রাকৃতিক পরিবর্তন আর নির্বাচন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে প্রজাতি সৃষ্টি করার উপায় নেই। সেটি প্রকৃতির আপন খেলার ফসল। জাত হলো মানুষের উদ্ভিদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফসল। মানুষ জাত সৃষ্টি করতে পারে, প্রজাতি নয়। পত্রিকায় যখন দেখি কোনো কোনো বড় গবেষক তার কোনো গবেষক ছাত্রকে নিয়ে ধানের প্রজাতি সৃষ্টির কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত রয়েছেন, সেটি তারা করেন জাত আর প্রজাতি সৃষ্টির ভেদ-প্রভেদ জানেন না বলেই। জীববিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জাত-প্রজাতির প্রভেদ বোঝার কথা। সাধারণের তা না জানা থাকারই কথা। ফলে সাধারণের এ ভুল নিতান্তই মার্জনীয়, জীববিজ্ঞানীদের নয় অবশ্যই।

লেখক: ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন