বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সে সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা ও পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। চাঁদপুরের শাহারাস্তি উপজেলায় জন্ম নেয়া পাপ্পু হবিগঞ্জের বানিয়াচং, নোয়াখালীর রায়পুর ও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় থেকেছেন। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহরে থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন, চষে বেড়িয়েছেন এলাকার অলিগলি। ছোটবেলা থেকে এই যে বিভিন্ন এলাকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার অভিজ্ঞতা, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বেড়ে ওঠা, এটিই চিন্তায় বৈচিত্র্য তৈরি করেছে পাপ্পুর মধ্যে।
বলছিলাম সুনামগঞ্জের তরুণ মানবেন্দ্র কর পাপ্পুর কথা। পেশায় তিনি একজন উদ্যোক্তা। সুনামগঞ্জ পৌরবিপণী মার্কেটে 'মধ্যবিত্ত' নামের ব্যতিক্রমী এক দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী তিনি। একসময় শুধু পোশাক বিক্রির মধ্য দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে সাজিয়েছেন বাহারি পণ্যের সমাহার। অল্পদিনেই সুনাম অর্জন করেছেন সৌখিন ক্রেতাদের মাঝে। করোনাকালে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি দিয়ে নিজের ব্যবসাকে আরও সুপ্রশস্ত করেছেন।
উদ্যোক্তা পাপ্পু একসময় ব্যবসায়ী ছিলেন না, ছিলেন চাকরিজীবী। ২০০৫ সালে কাজ করতেন গ্রামীণ ব্যাংকে। বছর দেড়েকের মধ্যে সেই চাকরি ছেড়ে যুব-উন্নয়ন অধিদপ্তরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ২০০৭ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালে চাকরি পান তৎকালীন ওয়ারিদ টেলিকমে।
২০১০-১১ সালের দিকে ওয়ারিদ টেলিকম এয়ারটেলে রূপান্তরিত হয়। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো। যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন, সে তুলনায় পারিশ্রমিক কম ছিল। তখনই পাপ্পু ভাবলেন, এবার চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে উদ্যোক্তা হবেন। নিজের ব্যবসায় পরিশ্রম যদি নিজের জন্য করেন, তাহলে আরো বেশি রোজগার করা যাবে। থাকবে চিন্তার স্বাধীনতা। এরপর ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মামার কাপড়ের দোকান দেখভালের দায়িত্ব নেন। জানতে পারেন ব্যবসার খুঁটিনাটি।
মানবেন্দ্র কর পাপ্পু বলেন, '২০১২ সালে মামাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে মামার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাই। তখন পুরোপুরি বেকার। মামার দোকান 'মাছরাঙা'তে বসি। আড্ডা দেই। টুকটাক কাপড় বিক্রি করি। তিন-চারদিন পর খেয়াল করলাম, কাস্টমারের রুচি ধরতে পারছি। আসলে ওয়ারিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করার কারণে সবার সাথে সহজে মিশতে পারতাম। কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার কারণে হিসাবটাও বুঝতাম সহজেই।'
২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল পাপ্পুর জন্মদিনের দিনেই 'মধ্যবিত্ত' যাত্রা শুরু করে। রুচিশীল পণ্য ও কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে সাজানো দোকানে প্রথম থেকেই প্রচুর ক্রেতার সমাগম হতো। এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে, দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় হতো না। সপ্তাহে ৬ দিন দোকান চালু রেখে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা যেতেন নতুন পণ্য আনতে। শনিবার সকালে সুনামগঞ্জে ফিরে আবার রাত পর্যন্ত ব্যবসা। এভাবেই চলেছে গত ছয় বছর।
পাপ্পু জানালেন, করোনার সময় অনলাইনে নিয়মিত ক্রেতা বেড়েছে। সারাদেশে কুরিয়ারে শার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবী, গজ কাপড় সহ নানান পণ্য পাঠাচ্ছেন। এছাড়া অন্দরসজ্জার টুকটাক সামগ্রী, যেমন— ফুলদানি, ছবির ফ্রেম, ঘড়ি, শো-পিস সহ নানা সৌখিন পণ্য বিক্রি করছেন। রয়েছে বাছাই করা কিছু বইয়ের সংগ্রহও। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় গজ কাপড়। মূলত মানসম্মত কাপড়ে আকর্ষণীয় নানা ডিজাইন ও প্রিন্টের কারণেই ক্রেতারা তার পণ্য পছন্দ করছেন।
ইতোমধ্যে কয়েকজন রিসেলার 'মধ্যবিত্ত'র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ৩০টিরও বেশি জেলায় নিয়মিত পণ্য পাঠাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে উদ্যোক্তা পাপ্পু বলেন, একসময় সারাদেশব্যাপি রিসেলার যুক্ত করতে চাই। শহরে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে, যারা পড়াশোনা কিংবা সংসারের পাশাপাশি ব্যবসাও করবে। নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ব্যবসায় নেমে সফল হতে হলে ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকতে হবে। প্রয়োজনে রিস্ক নিতে হবে। সবসময় নতুন কিছু চিন্তা করতে হবে এবং সময় দিতে হবে।