বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

৫০ বছর: সোনার তরি ও শীতের অর্থনীতি

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:০৩

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর| স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সময়সীমার মধ্যে অর্জন মোটেই হেলাফেলা করার মতো নয়। পরিসংখ্যানবিদরা নানা পরিসংখ্যান দিয়ে নানা ক্ষেত্রে সেই অর্জনের প্রমাণ হাজির করছেন। এসব পরিসংখ্যানের খোঁজখবর যারা রাখেন না, তেমন সাধারণ মানুষেরাও ঘোলা চোখে তাকিয়েই আশপাশের সেসব অর্জনের প্রমাণ পেয়ে যেতে পারেন এবং নিজেদের জীবনেই সেসবের কিছু না কিছু ছোঁয়া অনুভব করেন। বলতে গেলে এ অর্জনের পুরো কৃতিত্বটাও এদের, অর্থাৎ এই সাধারণ মানুষেরই। এরাই ‘কর্মযোগে ঘর্ম ঝরিয়ে’ সোনার ফসল ফলাচ্ছেন, দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করে তুলছেন। কিন্তু হায়, এই সোনার তরিতে কৃষকের স্হান হয় না| একটু ঠাঁই চেয়েই চরম নৈরাশ্যে পীড়িত হয়ে তাকে শুনতে হয়...

‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই—ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।’

রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীর নানা ধরনের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা অনেকেই করেছেন, আবার এসব ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপও করেছেন অনেকে। সে থাক, রবীন্দ্রনাথ যে বর্ষা ঋতু নিয়ে গান-কবিতা-প্রবন্ধ লিখেছেন, সে কথা আমরা জানি| কেউ কেউ তো তাকে ‘বর্ষার কবি’ বলেই অভিহিত করেন। তবে শুধু বর্ষা নয়, বাংলার সব ঋতুই যে রবীন্দ্রচিত্তকে অনুরণিত করেছিল, সে কথাটিও ভুলে থাকা সংগত নয়। শীত ঋতু নিয়ে রচিত তার এমন কিছু গানের কথা আমার মনে পড়ছে, যেগুলোর সূত্রে বাংলায় শীতের অর্থনীতির প্রকৃতিটিকেই আমরা চিনে নিতে পারব।

‘এলো সে শীতের বেলা বরষ পরে’/ এবার ফসল কাটো লওগো ঘরে’ বলে কবিগুরু যাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তারা ফসল কেটেছিল ঠিকই| কিন্তু কজন তারা সে ফসল নিজের ঘরে তুলতে পেরেছে? কিংবা ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়|/ ডালা সে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়’—কবির সে ডাকে সাড়া দিয়েছিল যারা, তাদের অবস্হাটা কেমন দাঁড়িয়েছিল? পাকা ফসলে পৌষের ডালা ভরলেই প্রকৃত চাষির ডালা তো শূন্যই থেকেছিল| কেন এমনটি হয়েছিল? এখনো কেন তেমনটি হচ্ছে?

এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বাংলার শীতের অর্থনীতির খোঁজ করতে হবে| তবে সে রকম কোনো অর্থনীতি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞজন ভেবেছেন কি না, তা আমার জানা নেই| অথচ তেমনটি হওয়া উচিত বলেই আমার মতো বিশেষ অজ্ঞের ধারণা|

সে রকম অর্থনীতি আমাদের জানাবে যে, শুধু শীত নয়, সব ঋতুই চাষি-মজুর তথা প্রাকৃতজনের জীবনের কেবল বঞ্চনাই ডেকে আনে| কোনো ঋতুই তাদের ‘ডালা’ ভরে দেয় না, বরং তাদের সবার ডালা উজাড় করে নিয়ে গোলা ভরে তোলে সেই সব ভাগ্যবানেরা ,‘মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ’ তবু ‘মাটির মালিক তাহারাই হন’|

আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায় এবং ‘সন্তানসম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়’ বলে জমির ফসলে তাদের কোনো অধিকার থাকে না| প্রকৃতিতে পৌষ মাস এলেও তাদের ঘরে আসে ‘সর্বনাশ’| ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’—এটাই বাংলার শীতের অর্থনীতির মূল মর্ম।

ছেলেবেলায় একটা মজার কবিতা পড়েছিলাম—‘বারো মাসের পেটপূজা’| কোন মাসে কী মজাদার খাবার খাওয়া যায়, কবিতাটিতে সেসবের বর্ণনা পড়তে পড়তে জিভে জল এসে যেত| পৌষ মাসের খাবার সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘পৌষমাসে পিঠেপুলি পাতলা খেজুর গুড়,/ নূতন কপি ভেটকি মাছ পেটটা যে ভরপুর’, সেকালে যে রকমই হোক, একালের পৌষ মাসে কজন পারে এ রকম খাবার খেতে খেতে পার্বণের আনন্দে মেতে উঠতে? পিঠেপুলির জন্য কোনোরকমে চাল জোগাড় করা গেলেও তেলগুড় কেনার সাধ্য গাঁয়ের কটা মানুষের আছে? আর খেজুর গুড়ে কিংবা ভেটকি মাছে যে ধরনের মারাত্মক বিষ মেশানো হয় বলে খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত পড়ি, তাতে তো শুধু শীতের নয়, পুরো বছরের অর্থনীতিকেই ‘মরণের অর্থনীতি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না|

যাহোক, আজকে কেবল শীতের অর্থনীতির কথাই বলতে চাই| শুধু একালের নয়, সেকালেরও| একালের অজস্র মানুষের শীতের কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে সেকালের কথা মনে পড়ে যায়| ‘সবার পিছে, সবার নিচে’ পড়ে থাকা ‘সর্বহারা’দের জীবন সব কালেই একই রকম| মধ্যযুগের ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে পাই ফুল্লরার বারো মাসের দুঃখের পাঁচালি| দুঃখিনী ফুল্লরার শীত নিবারণের কায়দা

— ‘দুঃখ কর অবধান, দুঃখ কর অবধান

জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ’

‘জানু’ মাসে হাঁটু, ‘ভানু’ মাসে সূর্য আর ‘কৃশানু’ মানে আগুন| অর্থাত্ শীতবস্ত্রের অভাবে ফুল্লরাকে হাঁটুতে হাত মুখ গুঁজে, গায়ে সূর্যের তাপ বা রোদ লাগিয়ে এবং আগুনের পাশে বসে শীতের প্রকোপ থেকে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করতে হয়| এ কালের ফুল্লরাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি?

না, তাদের অবস্হা আরো করুণ| সেকালের ফুল্লরাদের হাঁটুতে হাতমুখ গুঁজে থাকতে কিংবা পিঠে রোদ লাগাতে কেউ বাধার সৃষ্টি করেনি| আগুন জ্বালানোর সুযোগেরও অভাব দেখা দেয়নি| কিন্তু একালের ফুল্লরাদের বাস্ত্তচু্যত হয়ে শহরের নোংরা বস্তিতে বা কোনো গলি-ঘুপচিতে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে| কেমন সে আশ্রয়? সেখানে শীর্ণ জানুতে হাতমুখ গুঁজে শীত নিবারণের ব্যর্থ চেষ্টা করারও কোনো উপায় নেই| তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদোপম অট্টালিকা আড়াল করে রেখেছে ভানুকে, আর কৃশানুর জন্য সামান্য ইন্ধনও তাদের নাগালের বাইরে| সবচেয়ে কঠিন কষ্ট তাদের নাড়িছেঁড়া ধন শিশুপুত্রকন্যাদের নিয়ে| এই শীতে সর্দি-কাশি-জ্বর-নিউমোনিয়া হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে যেসব শিশু, তাদের সংখ্যা কত? টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় রোজ যতসংখ্যক শিশু মৃতু্যর খবর প্রকাশ পাচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যাটি কি তার চেয়ে বেশি নয়?

শুধু এ বছর নয়, প্রতি বছরই বাংলাদেশে শীতে মৃতু্যর খবর প্রকাশ পায় সংবাদমাধ্যমে| আমি কিন্তু সেসব খবর একদম বিশ্বাস করি না| হ্যাঁ, শীত ঋতুতে এমন কিছু মৃতু্য ঘটে, যা অন্য ঋতুতে ঘটে না| কিন্তু তাই বলে সে সবকে ‘শীতমৃতু্য’ বলে আখ্যায়িত করব কেন? শীত কি কোনো মৃতু্য ঘটাতে পারে? মানুষের মৃতু্য হয় রোগে ও দুর্ঘটনায়| শীত কি কোনো দুর্ঘটনা?

এরকম মৃতু্য স্বাভাবিক নয়, সর্বাংশেই অস্বাভাবিক| এই অস্বাভাবিকতার স্রষ্টাদের চিহ্নিত না করে এবং তাদের খুঁজে বের না করে কোনোদিনই এরকম মৃতু্যর কবল থেকে মুক্তির পথ খঁুজে পাওয়া যাবে না| কোনোরূপ রাখঢাক না করে স্পষ্ট বলে ফেলতে চাই, সমাজে যারা দারিদ্র্য সৃষ্টি করেছে, যারা প্রাকৃতজনের শ্রমের ফল অপহরণ করে নিয়ে নিজেদের চিকনাই বৃদ্ধি করেছে, তারাই ওদের স্বাভাবিক মৃতু্যর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে| এই হত্যাকেই ‘শীতের মৃতু্য’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

পাকিস্তান শাসনাধীন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের খতিয়ান দিতে গিয়ে এখনকার অর্থনীতিবিদরা পাকিস্তানের ‘দুই অর্থনীতি’র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন, পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য চালু থাকবে বৈষম্যহীন এক ও অভিন্ন অর্থনীতি—এমন প্রত্যাশাই ছিল আমাদের| কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ করে দিয়ে বাংলাদেশে যে সম্পূর্ণ পৃথক দুটি অর্থনীতি চালু হয়ে গিয়েছে, শীতের প্রসঙ্গসূত্রেই তা বুঝে নেওয়া যায়|

যে রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই রাষ্ট্রেই সমাজতন্ত্র লজ্জায় মুখ লুকাতে বাধ্য হলো| সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘লুটপাটতন্ত্র’। একুশ শতকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন লুটপাটতন্ত্রেরই বাহারি নামকরণ করেছে ‘বাজার অর্থনীতি’| এই বাজার অর্থনীতি বাংলাদেশের মতো দেশের হাটবাজারকে দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে| রাজধানী তো বটেই, অনেক মফস্বল শহরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নানা বাহারি নামধারী মার্কেট আর শপিংমল| এগুলোতে ঢুকেই লুটপাটতন্ত্রের বরপুত্ররাই দেশের শতকরা এক ভাগ মানুষের বিজয় ঘোষণা করে। অবশিষ্ট নিরানব্বইয়ের জন্য নয়, ঐসব মার্কেট। ঐ এক ভাগ মানুষের অর্থনীতির হাতেই পরাজয় ঘটেছে শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষের| এক ভাগের হাতে মার খাওয়া নিরানব্বইয়ের জন্য তৈরি হয়েছে অন্য অর্থনীতি। এই দুই অর্থনীতিই সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের ভেতর দুই বাংলাদেশ। প্রতি বছরের শীতে এই দুই বাংলার চেহারাকে বেআব্র‚ করে দেয়।

ইত্তেফাক/কেকে