শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

‘গ্রামবাসী দা-কুড়াল নিয়েই আমাদের সঙ্গে বাংকারে বসে গেল’

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২২, ০২:০৬

কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন মেজর (অব.) এ টি এম হামিদুল হোসেন বীরবিক্রম। মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন গণবাহিনীর। রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহে তার নেতৃত্বে অ্যাম্বুশ ও অপারেশনে দিশেহারা হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। রক্তঝরা ও অসীম সাহসিকতার দিনগুলো নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রাবস্হায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এ টি এম হামিদুল হোসেন বলেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। এরপর গোটা জাতি সংগঠিত হয়, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।’

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে হামিদুল হোসেন বলছেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর সৈনিক, পুলিশ এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শুরু করে মরণপণ গেরিলাযুদ্ধ। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নামে সাধারণ জনগণ। তাদের পদভারে  কেঁপে উঠত বাংলার মাটি তথা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর দেহমন।’ সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্হায় এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘অনেকে জীবনে কোনো দিন রাইফেল, গ্রেনেড কিংবা বাজুকা দেখেনি। তাদের যা কিছু ছিল—দা, কুড়াল, কাঁস্তে, হাতুড়ি, তিরধনুক অথবা হাতের কাছে যা কিছু পেত তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর। পৃথিবীর বুকে তারা সৃষ্টি করেছে জনযুদ্ধের ইতিহাস।’

কিছুটা আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘সেই জনযোদ্ধাদের জনযুদ্ধ ধীরে ধীরে এর মৌলিকতা হারিয়ে কিংবদন্িততে পরিণত হয়েছে। এতে করে জনযোদ্ধাদের প্রকৃত ঘটনা বিস্মৃতির অতলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমার নিজের দেখা সেই জনযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় বিরল গৌরবোজ্জ্বল অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।’ এ টি এম হামিদুল হোসেনের জন্ম বগুড়া জেলার সদর উপজেলার রজাকপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল হামিদ এবং মায়ের নাম মনোয়ারা হামিদ। তার স্ত্রীর নাম আজিজুন নেছা শাম্মী। তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।

পীরগঞ্জ অ্যাম্বুশ :নভেম্বর মাস। রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক। এখানে একটি বড় মোড় আছে, যা দৈর্ঘে্য প্রায় ৪০০ গজ। এখানে এলে গাড়ির গতি কমাতে হয় বাধ্যতামূলক। কারণ এখান থেকে কোনো পাশেই রাস্তা দেখা যায় না। ঠিক হলো এখানে অ্যাম্বুশ পজিশন নেওয়ার। হামিদুল হোসেন বলছেন, ‘মোড়ের দুই প্রান্েত দুই গ্রুপ ও ডান দিকে যে পুকুর ছিল, তার পাড়ে কভারিং পজিশন নিলাম। মুক্তিবাহিনী দেখে গ্রামবাসীর আনাগোনা বেড়ে গেল। আমি ও মালেক গ্রামবাসীদের যুদ্ধের কথা বুঝিয়ে বললাম। ওরা বলল, আমাদের সাহাঘ্যের প্রয়োজন আছে কি না। অ্যামবুশ পজিশনে বাঙ্কার খুঁড়ে দেওয়ার কথা বলতেই সবাই খুশি মনে কোনো রকম সাড়াশব্দ না করে বাঙ্কার খুঁড়ে দিল। অনেকে দা-কুড়াল নিয়ে আমাদের সঙ্গে বাঙ্কারে বসে পড়ল। বউ-ঝিরা আমাদের জন্য খাবার রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এবার রাস্তার পাশে একটি উঁচু বটগাছে মালেককে উঠিয়ে দিলাম একটি লাল গামছা হাতে। পাকিস্তানিদের দেখলেই যেন সে গামছা নেড়ে সংকেত দেয়।’ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমাদের তিনটি ট্যাংক গ্রামের ধার ঘেঁষে পজিশন নিচ্ছে আর বাকিগুলো পীরগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করছে। ঠিক এই সময় মালেক গাছের ওপর থেকে গামছা নাড়াতে শুরু করল। তার মানে, পাকিস্তানি সেনারা আসছে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনটি জিপ ও একটি ডজ ওয়ানটান ট্রাক অ্যামবুশের মধ্যে এসে গেল। শুরু হলো আমাদের ফায়ার। আমাদের সঙ্গে আমাদের পেছনে থাকা ট্যাংকগুলো দুমদুম ফায়ার শুরু করল। তিনটি জিপের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টি পল্টি খেয়ে রাস্তার অপর প্রান্েত পড়ে গেল। ট্যাংকের গোলা লেগে ট্রাকে আগুন ধরে গেল। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্বংসযঞ্জে পড়ে গেল। রাস্তার ওপর কয়েক জন গুরুতর আহত পাকস্তানি সেনা কাতরাচ্ছিল আর বাকিরা পালিয়ে গেল।’

অপারেশন ফুলবাড়ী :১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্হান রেকি করার পর যুদ্ধ-পরিকল্পনা তৈরি হলো। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে সেখানে আক্রমণ করবে। সিদ্ধান্ত হলো, প্রথম আক্রমণের সম্মুখ দল হিসেবে থাকবে মিত্রবাহিনীর দুটি দল। এ দুই দলের মধ্যবর্তী স্হানে হামিদুল হোসেন তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে থাকবেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন। পেছনে থাকবে মিত্রবাহিনীর অপর দুটি দল। সকাল থেকে শুরু হলো যুদ্ধের প্রস্ত্ততি। রাত ৯-১০টার মধ্যেই সবাই তৈরি হলেন। আক্রমণের জন্য যাত্রার নির্ধারিত সময় রাত ১১টা। এফইউপিতে (ফর্মিং আপ প্লেস) পৌঁছার সময় ভোররাত সাড়ে ৪টা। আক্রমণের সময় ভোর সাড়ে ৫টা। শীতের অন্ধকার রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সেনারা অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় সমবেত হলেন নির্ধারিত সময়েই। তখন রাত আনুমানিক ৩টা। সেখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি দিয়ে রওনা হলেন এফইউপির উদ্দেশে। তারা খুব সতর্কভাবে এগোতে থাকলেন কোনো প্রকার শব্দ না করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী সব মিলে প্রায় ৭০০ জন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু ইশারায় কাজ হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সেনারা এফইউপিতে অবস্হান নিলেন। তারপর সময় দ্রুত গড়াতে থাকল। এইচ আওয়ার (আক্রমণের সময়) আর মাত্র তিন মিনিট। এ টি এম হামিদুল হোসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতে অস্ত্র, ট্রিগার হাতে সবেমাত্র পা বাড়িয়েছেন এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেদ করে বিকট শব্দ। আক্রমণের তখনো আড়াই মিনিট বাকি। মিত্রবাহিনীর একজন সৈনিকের হাত থেকে উত্তেজনায় পিনখোলা গ্রেনেড মাটিতে পড়ে এই বিপত্তি। গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পাকিস্তানি সেনারা বুঝে গেল তাদের ওপর আক্রমণ আসন্ন। সঙ্গে সঙ্গে তারা আক্রমণ শুরু করল। ওদের সব বাংকার থেকে মেশিনগান, লাইট মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হলো। মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার গুলি যাচ্ছে। হামিদুল হোসেন তাতে বিচলিত হলেন না। সহযোদ্ধাদের নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। এমন সময় মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। প্রথম লেয়ার শেষ হওয়ামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা এ টি এম হামিদুল হোসেনের নেতৃত্বে জয় বাংলা চিত্কার দিয়ে গুলি করতে করতে ধাবিত হলেন পাকিস্তানি অবস্হানের দিকে। শুরু হলো ডগফাইট। একটু পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংকারগুলোতে গ্রেনেড চার্জ করতে শুরু করলেন। কয়েকটা বাংকার ধ্বংস হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাব্যবস্হা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এলো। সেদিন সূর্য ওঠার আগেই ফুলবাড়ী অপারেশন শেষ হয়। এই যুদ্ধে আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। হামিদুল হোসেন ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৭ নম্বর সেক্টরের তপন সাব-সেক্টরে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে তাকে মেজর হিসেবে অকালীন অবসর দেওয়া হয়।

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন