শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সাত বার রিফাইনারির ডিপোতে বোম্বিং করে ধ্বংস নিশ্চিত করি

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২২, ০৯:৩৮

পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর তরুণ পাইলট শামসুল আলম। তখন পোস্টিং পাকিস্তানের রাওয়াল-পিন্ডি। যুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেননি। এক মাসের ছুটি নিয়ে এলেন করাচি। উদ্দেশ্য— বাংলাদেশে ফিরবেন, যোগ দেবেন মুক্তিযুদ্ধে। ব্যাংক থেকে জমানো ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ হাজার (তখন মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়ির দাম ১৩ হাজার টাকা) তুলে ফেললেন। টাকা তোলার কারণে যে তিনি সন্দেহে পড়েছেন, সেটা বুঝতে পারেননি। বাহিনী থেকে অনুমতি না নিয়েই উঠে পড়লেন পূর্ব পাকিস্তানের বিমানে। ঢাকার নামার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার হলেন। নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। শুরু হলো টর্চার। দিনের পর দিন নির্যাতনের পর মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো। এক পর্যায়ে হলেন কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ডামাডোল চলছে। অনেক বেশি পাইলট দরকার পাকিস্তানের। ১৪ আগস্ট তাকে নিয়ে যাওয়া হলো বেজ কমান্ডার এয়ার কমডোর এনামুল হকের কাছে। একজন অফিসারের নির্যাতনের চিহ্ন দেখে বিস্মিত হলেন বেজ কমান্ডার। তাকে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। তাকে শান্ত করতে ঐ কর্মকর্তা সাত দিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দিলেন। আর সেটাই কাজে লাগিয়ে চলে গেলেন ভারতে। যোগ দিলেন যুদ্ধে। অপারেশন কিলোফ্লাইটের এই অকুতোভয় বীরের নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলম বীর উত্তম। ২০১৭ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদকও।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, আগস্টে ২৪-২৫ তারিখে পৌঁছালেন ভারতে। সেখানে তাকে একটি হোটেলে রাখা হলো। অনেকেই সেখানে ছিলেন। একদিন এ কে খন্দকার তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন দিমাপুর। সেখানেই ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমরা কলকাতায় অপেক্ষা করছিলাম বিমানবাহিনী গঠনের জন্য। কিন্তু সমস্যা হলো, বাহিনী গঠন করে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বিমান পাওয়া যাচ্ছিল না। বাংলাদেশ যদি ভারতের ফাইটার বিমান ব্যবহার করে এবং কোনোভাবে যদি তা বিধ্বস্ত হয় বা শত্রুসেনার হাতে যায় তবে তো সেখানে ভারতীয় পতাকা থাকবে। ভারত তো অফিশিয়ালি তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে সরাসরি সাহাঘ্য করছে না।’

শামসুল আলম বলেন, ভারত বিমান দিল অবশেষে। তবে তারা এমন বিমান দিল যেন বলতে পারে যে, এটা তাদের বিমান নয়।  

 তারা দিল একটা ‘ডিসি থ্রি’, যেটা পাকিস্তানেরও আছে, ভারতেরও আছে। একটা ডিসি থ্রি এবং একটা অ্যালবার্ট থ্রি হেলিকপ্টার। আর ছিল আরেকটা অর্টার প্লেন। বিমানগুলো চলে এলো। যখনই তাদের নতুন বিমানে মানিয়ে নেওয়া হলো, তখনই তারা বিমানগুলোকে একটা ডামি বোম্বার এয়রক্রাফটের মতো ব্যবহারের চেষ্টা করছিলেন। শুরু হলো ডামি ফায়ারিং। এরপর শুরু হলো লাইভ ফায়ারিং। বিমানটার পেছনে পেট বরাবর কেটে ফেলে তিনটা বম্ব র্যাক বসানো হলো। একেকটা র্যাকে চারটা করে বোমা। মোট ১২টি বোমা; যার প্রতিটির ওজন পঁচিশ পাউন্ড করে। থাকবে একজন গানার, যে বন্দুকটা চালাবে। আর পেছনে থাকবে একজন বোম্বাডিয়ার। প্লেনের কমান্ডার যখন নির্দেশ দেবে তখন গানম্যান ফায়ারিং শুরু করবে। আবার যখন কমান্ডার বলবেন, ‘ড্রপ দ্য বম্ব নাউ।’ তখন বোম্বাডিয়ার দুটি বোমের পিন খুলবে। এভাবে প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে পারফেকশন চলে এলো। এই ট্রেনিং শেষ হতে হতে অক্টোবর শেষ হয়ে গেল। নভেম্বরের মাঝামাঝি তাদেরকে জোড়হাটে ডাকা হলো। এই বেসক্যাম্পের যে কমান্ডার ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন। চন্দন সিং বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন। বললেন, যার জন্য তোমাদের এতদিনের অপেক্ষা সেই সময় চলে এসেছে।

চন্দন সিং বললেন, একসঙ্গে দুটি অপারেশন হবে। ডিসি থ্রি যাবে চট্টগ্রাম ওয়ের রিফাইনারি ধ্বংস করতে। আর হেলিকপ্টার যাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় তেলের ডিপোতে বোম্বিং করবে। এই প্রথম শুনলেন তারা টার্গেট। শামসুল আলমের পাশেই বসে আছেন সুলতান মাহমুদ। তিনি শামসুল আলমকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কিছু বলার বা জানার আছে কি না? শামসুল আলম বললেন, ‘স্যার, অয়েল রিফাইনারিতেই কেন? যুদ্ধ শেষ হলেই তো আমাদের অয়েল রিফাইনারি লাগবে। তখন কোত্থেকে আসবে? একটা ট্যাংক না হয় এক মাসে তৈরি করে নেওয়া যায় কিন্তু একটা রিফাইনারি, যেখানে যন্ত্রপাতি তৈরি হয়, তেল পরিশোধন করা হয়, স্বাধীনতার পরপরই তো তেলের চাহিদা হবে। গাড়িতে, প্লেনে, সবখানে তেল লাগবে। সেই তেলটা আসবে কোথা থেকে? ফলে টার্গেটটা আমাদের পরিবর্তন করা দরকার।’

চন্দন সিং আরো জিজ্ঞাসা করলেন, আর টার্গেট ধ্বংস করতে তারা অনিচ্ছুক কি না? শামসুল আলম জানালেন যে, তারা সারা দেশের কোনো ফুড স্টোরেজ ধ্বংস করতে চান না। তিনি বলেছিলেন, আমাদের উচিত হবে না এলোপাতাড়ি রেললাইন ধ্বংস করা। রেলওয়ে লাইন ছিল ইস্ট পাকিস্তানের প্রধান লাইন। চন্দন সিং তাকে ধন্যবাদ দিয়ে আবারও বললেন, তারা এভাবে ভেবে দেখেনি। এরপর সুলতান মাহমুদ তার কথাগুলো বললেন। সবশেষে চন্দন সিং বললেন, তিনি আলমের কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন। আজকের আলোচনার সব কথা তাদের কনফারেন্সে তিনি আলোচনার জন্য তুলবেন এবং তাদের অভিমত তিনি ঊর্ধ্বতনদের অবহিত করবেন।

চার দিন পর আবারও তাদের ডাক পড়ল। শামসুল আলককে জানানো হলো, তার প্রস্তাব হাইকমান্ড খুব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন এবং সবাই খুব খুশি। তাকে একটা ছবি দিয়ে বলা হলো যে, এটা তিন-চার দিন আগে তাদের ক্যানবেরা বোম্বার এয়ারক্রাফট থেকে তোলা। এটা হলো পাকিস্তানের চট্টগ্রাম এয়ারফিল্ডের ফুয়েল স্টোরেজের ছবি। তারা ২৪ নভেম্বর দিমাপুর থেকে টেকঅফ করে কৈলাস শহরে চলে এলেন। দিমাপুর থেকে কৈলাস শহর ঘণ্টাখানেকের পথ। তিনি, কো-পাইলট আকরাম, গানার , বোম্বাডিয়ার এবং গ্রাউন্ডসম্যান, মোট ছয় জন মানুষ কৈলাস শহরে এলেন। বিকালে নেমে দেখলেন রানওয়ের চারদিকে তাঁবু খাটানো। রাত পেরিয়ে ২৫ তারিখ ভোর হলো। ২৫ পেরিয়ে ২৬ তারিখ টেকঅফের দিন শুরু হবে। যেতে হবে অপারেশনে।

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, দিন পেরিয়ে বিকেল হচ্ছে। বেলা ৩টা/৪টা, তিনি রেডি হচ্ছেন। সবাই খুব উত্তেজনা বোধ করছেন ভেতরে। হঠাত্ সাড়ে ৪টার দিকে মোটরসাইকেলে একজন এসে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। ইংরেজিতে যা লেখা, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়—অপারেশন কিলোফ্লাইটের ২৬ নভেম্বরের অপারেশন স্হগিত করা হলো। অপেক্ষা চলছে। অবশেষে ২ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় আবার সেই লোকটি এলো মোটরসাইকেলে চেপে। এসে আবার একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। সেখানে লেখা, অপারেশন কিলো ফ্লাইটের অভিযান আজই হবে। এটার পরিবর্তন হবে না, এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সঙ্গীদের ডাকলেন তিনি। আজকেই সেই দিনটি। সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। সবার সঙ্গে বুক মেলালেন। গ্রাউন্ডসম্যানদের বলা হলো এয়ারক্রাফট রেডি করতে। সবকিছু রেডি করে সাড়ে সাতটার সময় তারা স্টার্ট করলেন এয়ারক্রাফট। শুরু হলো যুদ্ধযাত্রা। যে যুদ্ধের জন্য তারা এতদিন প্রস্ত্তত হয়েছেন। রাতের অন্ধকারে পাহাড়, বনাঞ্চলের ওপর থেকে উড়ে চলল শামসুল আলমের বিমান। পাশে কো-পাইলট ক্যাপ্টেন আকরাম। একটা ভি আকৃতি করে বিমান উঠে এল চট্টগ্রামের দিকে। আস্তে আস্তে দৃষ্টিসীমায় এলো রিফাইনারি, একটা চক্কর দিয়ে এলেন রিফাইনারির ওপর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র। অথচ তাদের বলা হয়েছিল রিফাইনারির কোনো পাহারা নেই। কিন্তু তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, এখানে বিমান ধ্বংসকারী অস্ত্রসহ পাহারা আছে। এখন তারা কী করবেন? যুদ্ধ ছেড়ে যাবেন? না, শামসুল আলম বললেন, ‘প্রাণ গেলেও টার্গেট শেষ করে তবে যাব।’ একবার নয়, দুবার নয়; সাত বার এ রিফাইনারিতে বোম্বিং করলেন তারা। প্রতি বার বিমানের পাশ থেকে উড়ে উড়ে গেল গোলা। যে কোনো একবারে শেষ হতে পারত তাদের জীবন। শেষ পর্যন্ত সাহসের জয় হলো। দূর থেকে দেখলেন তেলের ডিপো থেকে আগুনের কুণ্ডলী উঠছে। এভাবেই ধ্বংস হলো পাকিস্তানিদের তেলের সবচেয়ে বড় সংরক্ষণাগার। এর পরও একাধিক অপারেশনে অংশ নিয়েছেন অকুতোভয় এই বীর। পরবর্তী সময়ে এই কিলোফ্লাইট ইউনিটটি ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯০টি অভিযান এবং ৪০টি যুদ্ধের মিশন পরিচালনা করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলাকা বিমানও চালিয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর পারিবারিক ব্যবসা দেখেই সময় কাটাচ্ছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন