ই-বর্জ্য দূষণ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি। এমন কি ঘটতে পারে প্রাণহানিও। বিষয়টি অনেক মানুষ জানেনই না, আর কেউ জানলেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যে সমস্ত ইলেকট্রনিক দ্রব্য ব্যবহারের পর অচল বা সচল অবস্থায় যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয় তা-ই ই-বর্জ্য।
যেমন—পরিত্যক্ত টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, মাইক্রোওভেন, সিএফএল বাল্ব, ওয়াশিং মেশিন, মুঠোফোন, ডিভিডি প্লেয়ার, পানির ডিসপেন্সার, ওয়াটার পিউরিফায়ার, রেডিওথেরাপি মেশিন, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, ড্রিল মেশিন, ইলেকট্রনিক খেলনাসামগ্রী ইত্যাদি। ই-বর্জ্যের এই ভয়াবহ দূষণ বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর কি পরিমাণে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারি সংস্থা (ESDO)-এর গবেষণা প্রতিবেদন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—২০১৮-তে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বছরে তিন মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (BMPIA)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশে ১ লক্ষ ৪২ হাজার টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো কর্তৃক জুন ২০১৯-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ, আর ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রকাশিত BTRC-এর প্রতিবেদন বলছে দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার। অর্থাত্ বলা যায়, দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ ব্যবহার করে মোবাইল ফোন। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতি বছর ২০-২৫ শতাংশ মোবাইলের ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সেই হিসেবে দেশে শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের থেকেই একটা বিশাল পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যার আনুমানিক সংখ্যা হবে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন ই-বর্জ্য।
তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন ধরনের পণ্য উদ্ভাবন হচ্ছে। ফলে ব্যবহারকৃত ডিভাইসটি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে যত্রতত্র ফেলে দিয়ে, নতুন ডিভাইস ক্রয়ে আগ্রহী হয় মানুষ। যত্রতত্র ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত ই-বর্জ্য এক সময় স্থান পায় ভাঙ্গারির দোকান। বিক্রেতাগণ বর্জ্যগুলোকে দোকানে না রেখে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। এভাবে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায়, রোদ, জলে, ভূগর্ভে যেমন দূষণ ছড়ায়, তেমনি এগুলো সংগ্রহ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মানুষের মধ্যেও বাড়িয়ে দেয় স্বাস্থ্যঝুঁকি। একই সঙ্গে মাটি, গাছপালা, ফসল ও জীববৈচিত্রের অনেক ক্ষতি হয়।
ফলে ধীরে ধীরে এক সময় জলবায়ুর পরিবর্তনও ঘটে। বিশেষজ্ঞগণ বলেন, ই-বর্জ্যে ১ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ থাকে এবং নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, টেলিভিশন ও কম্পিউটার মনিটরে থাকা সিসা, পারদ, কপার ও মাদারবোর্ডে থাকা বেরিলিয়াম, সেলফোন, রেফ্রিজারেটর ও এসিতে ব্যবহূত ক্ষতিকর পদার্থসমূহ শরীরে ক্যানসার, কিডনি নষ্ট হওয়া ও থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করাসহ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। এছাড়াও ই-বর্জ্য ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দূষণের মাধ্যমে সুপেয় পানির প্রাপ্যতাকে কঠিন করে তোলে। যার প্রভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশ বিস্তার। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাস্ত্ততন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলা।
সুতরাং ই-বর্জ্যের ভয়াবহ দূষণ রোধে, ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানার সংখ্যা বাড়াতে হবে। জানা যায়, দেশে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা কয়েকটি মাত্র, যা আমাদের ই-বর্জ্যের তুলনায় অপ্রতুল। আর কারখানার সংখ্যা বাড়াতে পারলে যেমন হবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, তেমন রোধ হবে জলবায়ুর পরিবর্তনও। সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের ই-বর্জ্য দূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রশাসনের কঠোরতা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। একই সঙ্গে ক্ষতিকর দিকগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, মৌকারা দারুচ্ছুন্নাত নেছারীয়া কামিল মাদ্রাসা, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা