প্রতিদিনই ঢাকায় বাড়ছে মানুষ আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। অসহনীয় যানজট, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত দূষণসহ নানা কারণে অতিষ্ঠ এ শহরের বাসিন্দারা। শিক্ষা, চাকরি, বেকারত্ব, নদী ভাঙন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার দিকে প্রতিদিনই পাড়ি জমাচ্ছে বহু মানুষ। এতে গত কয়েক দশকে ঢাকার জনসংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান ঢাকা একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ শহর এবং এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ বসবাস করে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও জনসাধারণের জন্য গণপরিবহন এখনো অপ্রতুল। ঢাকায় গত এক দশকে বাস-মিনিবাসের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল বেড়েছে অনেক বেশি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার, যা ২০১০ সালে ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার। অন্যদিকে ২০১০ সালে ঢাকায় বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৩১৩ এবং বর্তমানে ৪৭ হাজার ৪৮৪টি। কিন্তু গণপরিবহনের সংখ্যাটা যে জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয় তা গণপরিবহনে ভিড় দেখলে সহজেই অনুধাবন করা যায়। এহেন পরিস্থিতিতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য, নারীদের সঙ্গে অসদাচরণ, ভাড়া বৃদ্ধিতে অসহনশীলতা ইত্যাদি কারণে যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে।
বর্তমান সময়ে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে তীব্র যানজট। সরু রাস্তা, চালকদের অহেতুক ওভারটেকিং ট্যান্ডেন্সি, পার্কিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, গণপরিবহনের চেয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে যানজট প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যার দরুন প্রতিদিনই নগরবাসীর নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কর্মঘণ্টা।
ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ শুধু গণপরিবহন আর যানজটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রয়েছে সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ, শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও মুক্ত বাতাসেরও অভাব। অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সরু নালা, বন্ধ নর্দমা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতাসহ প্রভৃতি নানা কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ঢাকার আশপাশের নদী, খাল ও অন্যান্য জলাশয় এখন প্রায় মৃত। যার দরুন মানুষের জন্য অপরিহার্য পানি যে ভূগর্ভস্থ থেকে আসে মানবসৃষ্ট দূষণে দিন দিন সেটিও নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকায় অতিদ্রুত সুপেয় পানির ঘাটতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকায় প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কয়েক ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে।
তাছাড়া এ শহরে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ তো আছেই। বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা সুইজারল্যান্ডের প্রযুক্তি কোম্পানি আইকিউএয়ারের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ ছিল বাংলাদেশ। আর রাজধানী শহর বিবেচনায় সেই তালিকায় ভারতের নয়াদিল্লির পরপরই অবস্থান ঢাকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক ঘনমিটার বাতাসে বছরে পিএম২.৫-এর উপস্থিতির গড় পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আইকিউএয়ারের রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতির গড় ছিল ৭৬.৯ এবং রাজধানী ঢাকায় ৭৮.১। এই দূষিত বায়ুর কারণে মানবদেহে এলার্জি, কাশি, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, মাথাব্যথা, ফুসফুসে ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক রোগ হতে পারে। তাছাড়া দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকিও বহুগুণ বেড়ে যায়।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি জরিপ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। এমতাবস্থায় ঢাকার দিকে বিশেষ নজর প্রদান করে শহরটিকে বসবাসযোগ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও উন্নয়নমূলক কাজের সমন্বয় ব্যতীত তা কখনোই সম্ভবপর হয়ে ওঠবে না। নগরায়ণ করতে গিয়ে ঢাকাকে যেভাবে বৃক্ষশূন্য করে দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ করে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা উচিত। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ তথা সব দূষণের এ শহরে দূষণ কমানো ছাড়া প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই দূষণ কমাতে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। শিল্প, কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্হাপনা নিয়মের মধ্যে আনা, অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো থেকে চালকদের সাবধান করা, নির্মাণসামগ্রী রাস্তাঘাটে যত্রতত্র ফেলে না রেখে তা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। যানজট নিরসনে যত্রতত্র পার্কিং বন্ধ করা অপরিহার্য। তাছাড়া রাস্তার পাশের ফুটপাতগুলো অবৈধ দখলদারদের থেকে মুক্ত করা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে দ্বিতল গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, প্রত্যেকটা শিক্ষা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা, সংস্কার কাজে সমন্বয় সৃষ্টি ও দ্রুত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা অত্যাবশ্যক। ঢাকাকে বাসযোগ্য শহরের তলানি থেকে উত্তরণ ঘটাতে দুই সিটি করপোরেশন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। করপোরেশনের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক নাগরিকের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য খেলার মাঠ, পার্ক, জলাশয় তৈরি ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমাতে শিল্প কলকারখানা এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় অফিসগুলো অন্য শহরগুলোতে স্থানান্তর করা যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ