শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৩৪

পোশাক খাতের পরপরই দেশের জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান জনশক্তি রপ্তানি খাতের। দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম উদ্দেশ্য। ১৯৭৩ সালে সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে সেসব দেশের ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থনীতিই বাংলাদেশসহ তৎকালীন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনশক্তি রপ্তানির দ্বারোন্মোচন করে।

১৯৭৬ সালে প্রথম জনশক্তি রপ্তানি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বাড়তে থাকে রেমিট্যান্স আয়, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। বিএমইটির তথ্য মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশি অভিবাসীদের পাঠানো মোট বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ২৩২ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। করোনা মহামারিতে বিশ্ব জুড়ে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স আয় অব্যাহত ছিল, যা অত্যন্ত আশার কথা। তাই দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত মজবুত করতে অব্যাহত রাখতে হবে রেমিট্যান্স প্রবাহ। যার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল প্রস্তুতি, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান এবং জনশক্তি রপ্তানি খাতে দালালদের দৌরাত্ম্য কমানো। নতুবা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির মূল গন্তব্য উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (জিসিসি) ছয়টি দেশ। অর্থাৎ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, ও কাতার। পরবর্তী সময়ে এই তালিকায় যুক্ত হয় মালয়েশিয়ার নাম। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়েছেন, যার ৭৫ শতাংশই আছে মধ্যপ্রাচ্যে। এবং প্রতি বছর বৈধ ভাবে ১০ লাখের অধিক কর্মী বিদেশ যান। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও একথা সত্য, এদের মধ্যে দক্ষকর্মী মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। অদক্ষ কর্মী প্রেরণের সবচেয়ে বড় কারণ জনশক্তি রপ্তানি খাতে দালালদের দৌরাত্ম্য। এসব কর্মী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল যোগাযোগ ও ভাষায় অদক্ষতা, আচরণগত সমস্যা, শারীরিক যোগ্যতার অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা, অভিবাসী দেশের আইন সম্পর্কে অবগত না থাকা, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণবশত কাজে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির মানকে নিম্ন দিকে ধাবিত করে। স্বল্প দক্ষ কর্মীরা কিছুটা কাজ শিখে নেওয়ার চেষ্টা করলেও শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান না। গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনেকে দালালদের খপ্পরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আশায় জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে ভিনদেশে পড়ে বিপাকে। দীর্ঘ পরিশ্রমের পরও অধিকাংশই বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলতে পারেন না, যা এক দিকে যেমন ব্যক্তিগত ক্ষতি অন্য দিকে কমাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের কর্মীদের মান। বিগত দিনে মালয়েশিয়ার একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি স্থগিত করা এর অন্যতম উদাহরণ। দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে সরকার যথাযথ উদ্যোগী হলেও একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দালাল চক্রের দৌরাত্মে্যর ফলে অব্যাহত থেকে যাচ্ছে অদক্ষকর্মী প্রেরণ। এছাড়া দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশ গমন এবং প্রতারিত হওয়ার উদাহরণও কম নয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তির অগ্রসরমানতা এক দিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, অপরদিকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছে বহু গুণে। দুনিয়া জুড়ে অটোমেশন ও স্মার্ট ডিভাইস-কেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি ও উত্পাদন সক্ষমতার বিপরীতে আমাদের কৃষি, শিল্প, বিপণন ও পরিবহন ব্যবস্থা এখনো অনেকটা সেকেলে। ফলে প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে অন্যান্য অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ, যা অনেকটাই আশঙ্কাজনক। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে ও বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতার কারণে বেকার হয়ে যেতে পারে। শ্রমবাজার ধরে রাখতে শিল্পবিপ্লবের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। কর্মীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণবশত ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার। ফলে মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা কাটিয়ে নতুন স্থায়ী শ্রমবাজার অনুসন্ধানে উদ্যোগী হওয়া জরুরি। বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নত প্রতিটি দেশেই দক্ষ জনগোষ্ঠীর চাহিদা রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে আমাদের জনমিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ কাজে জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে পরীক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত অভিবাসীদের যে কোনো সমস্যা সমাধানে দূতাবাসগুলোকে তত্পর হতে হবে।

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই জনশক্তি রপ্তানি খাতে সরকারকে সচেতন দৃষ্টি দিতে হবে, বাড়াতে হবে এ খাতে বিনিয়োগ। দালাল বা এজেন্সির দৌরাত্ম্য দূর করে সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ একদিকে যেমন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা বাড়াবে। অপর দিকে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহ সমৃদ্ধ করে তুলবে দেশের অর্থনীতি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন