বঙ্গবন্ধুর প্রাপ্ত জুলিও কুরি শান্তি পদক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা। একজন বাঙালি যিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হন সেই ১৯৬৯ সালে। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাকে করেছে বাঙালির ‘অবিসংবাদিত নেতা’। তিনিই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত হন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্বশান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে কর্তৃত্ববাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে ও শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে।
নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব ধরনের কর্তৃত্ববাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের সুনাম অর্জন করেন। আর বিশ্বমানবতায় অসামান্য অবদান রাখার কারণে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে। বিশ্বশান্তি পরিষদের এ পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক পদক।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ ও ’৫২ সালে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু মূলত স্বাধীনতারই ঘোষণা দেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বিশ্বপরিস্থিতি শান্তি, প্রগতি, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অনুকূলে পরিবর্তিত হয়েছিল।
আমার বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল তিনটি : প্রথমত তিনি হাজার বছরের নিষ্পেষিত, শোষিত, অবহেলিত আত্মপরিচয়হীন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা তথা বাঙালি জাতি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়ত পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তৃতীয়ত অবহেলিত, নিপীড়িত এই বাঙালির নিজের মতামত, অধিকার, আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। প্রথম ও তৃতীয় স্বপ্নটি তিনি বাস্তবায়ন করে গেছেন তার দূরদর্শী, সাহসী, সৎ এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে। তিনি সমগ্র বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিসংগ্রামের জন্য সংগঠিত করে আমাদেরকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন। আর অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান রচনা করে তার আলোকে গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। শুধু বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের কারণে। এই আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার কাজটি বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনের সব উদ্যোগ নিয়ে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্ক স্থাপন করে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একটি সম্মানীয় দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ বঙ্গবন্ধুর বাস্তব এই ভূমিকার ফলে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
শান্তি পরিষদের ঐ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বশান্তি পরিষদ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে ১৯৭৩ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে’। বঙ্গবন্ধুর আগে যারা ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, নিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তার মহান আদর্শ, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবিক উদ্দেশ্য এবং তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আছে। আর সংগত কারণেই বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির ৫০ বছরে এসে তরুণ প্রজন্মের কাছে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের মন মননে এই চেতনা গ্রথিত করা অত্যাবশ্যক।
লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়