বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

করোনার টিকা: ঝুঁকির চেয়ে লাভ বেশি

আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৩৪

আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের মহামারি শুরুর পর থেকেই এই অণুজীবটি তার গতিপ্রকৃতি, চিকিত্সার ওষুধ ও টিকা, পার্শ্ব বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মনে নানা কৌতূহল ও সন্দেহের উদ্রেক করেছে। অনেকেই বিভিন্নভাবে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এই ভাইরাসটি পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত আসা অণুজীবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে এবং এর কোনও চিকিৎসাপদ্ধতিও জানা ছিল না। 

তাছাড়া এটি অন্যান্য মহামারির মতো কোনও একটা বিশেষ দেশ বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বে একযোগে তার মারণথাবা বিস্তার করেছে এবং নিত্যনতুনভাবে রূপ পালটাচ্ছে। সে কারণে সচেতনতার জন্যই মানুষের মনে নানাবিধ প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। ভাইরাসটি প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত নাকি কোনও ল্যাবরেটরিতে মনুষ্যসৃষ্ট—এ নিয়েও বহু মানুষের মনে প্রশ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ভাইরাসটির উৎস খুঁজতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানী দলকে এখনো চীনে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়াতে সংস্থাটির খোদ প্রধানের হতাশা প্রকাশের ঘটনায় এই সন্দেহ আরও দানা বাঁধছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে করোনা ভাইরাসের টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে।

আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, সত্যকে যেহেতু দীর্ঘদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না, তাই উপরিউক্ত সব প্রশ্ন ও সন্দেহগুলোর উত্তর একসময় নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু এর মধ্যে প্রতিদিন যেভাবে বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে তো বিজ্ঞানীরা ভবিতব্যের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। মানুষকে বাঁচাতে হলে রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে, প্রতিরোধের জন্য টিকা বের করতে হবে, প্রতিরোধের জন্য আবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে হবে। এত দিন আমরা যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের জন্য ওষুধ খুঁজেছি। কিছু বেরিয়েছে, ফলে মৃত্যুহার কিছু কমেছে। কিন্তু আরও কার্যকর চিকিৎসা এখনো আমরা খুঁজছি। টিকা ছিল না। 

আরও পড়ুন: সরকারি দুর্নীতিই সবচাইতে ‘বড় সমস্যা’

সারা বিশ্বে একাগ্র অনুসন্ধানের ফলে কয়েকটি দেশে বেশ কয়েকটি টিকা বেরিয়েছে। এখনো আরও কিছু টিকার পরীক্ষা চলছে। এগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা শতভাগ নয়। কিন্তু যতদিন এর চাইতে কার্যকর ও এর চাইতে নিরাপদ কোনও টিকা হাতে না আসছে, ততদিন তো আমাদেরকে এগুলোই ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর মানুষ যেখানে অনন্যোপায় হয়ে প্রস্তুত ছিল কোনও টিকা ৫০ শতাংশ কার্যকর হলেও তা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার, সেখানে এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ। যখন এর চেয়ে বেশি কার্যকারিতার টিকা পাওয়া যাবে তখন নিশ্চয়ই আমরা সেটাই ব্যবহার করব।

উল্লেখ্য, আজকের পৃথিবীতে বহুল ব্যবহৃত ফ্লু ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিন্তু মাত্র ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়। ফ্লুর টিকা নেওয়ার পর এর শরীরে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। যে কারণে এই টিকা প্রতি বছর নিতে হয়। সে তুলনায় ইয়েল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা, ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোল্লা ইন্সটিটিউট অব ইমিউনলজি—এই চারটি বিখ্যাত গবেষণাগারের গবেষণায় দেখা গেছে যে, নব-আবিষ্কৃত করোনার এই টিকাগুলো নেওয়ার পর অধিকাংশ রোগীর শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি ছয় থেকে ১২ মাস, এমনকি আরও বেশি সময় স্থায়ী হয়। তদুপরি পুনরায় আক্রান্তের হারও অত্যন্ত নগণ্য।

আরও পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ার বিমান দুর্ঘটনা: খবরের অপেক্ষায় স্বজনরা

আরও আছে। এত কাল আমরা টিকার কার্যকারিতার জন্য শুধু টিকার কারণে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির স্থায়িত্বের ওপরই নির্ভর করতাম। কিন্তু এখন বিজ্ঞান জেনেছে যে, শরীরে অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব কম হলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা শরীরে এত কিছু করে রেখেছেন যে আগে এগুলো জানা ছিল না। অ্যান্টিবডি না থাকলেও টিকা দেওয়ার পর শরীরের বি-সেল ও টি-সেলদেরকে এই এন্টিজেনের অর্থাৎ সম্ভাব্য করোনা ভাইরাসের চেহারা চিনিয়ে রাখে। যদি কখনো করোনা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে তখন অ্যান্টিবডি না থাকলেও এই বি-সেল ও টি-সেলগুলো তাকে ঘিরে ধরে, আক্রমণ করে এবং আরও প্রচুর সংখ্যায় বি-সেল ও টি-সেল তৈরির জন্য শরীরকে বার্তা পাঠায়। এই বার্তা পেয়ে শরীর তা তৈরি করে এবং করোনা ভাইরাস পর্যুদস্ত হয়। এমন চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শরীরে থাকার পরেও আমরা টিকা নিয়ে কেন তাকে সাহায্য করব না?

নিরাপত্তার প্রশ্নে বলা যায় যে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত করোনা টিকার কোনোটাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। সবগুলো টিকাই সাধারণভাবে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে কিছু অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া, যার অধিকাংশই মৃদু, হালকা জ্বর, গায়ে সামান্য ব্যথা, ইনজেকশন দেওয়ার জায়গা কিছুটা ফোলা বা লাল হওয়া, মাথাব্যথা ও ক্লান্তি। তবে এগুলো সবই স্বল্পস্থায়ী এবং সামান্য ব্যথা বা জ্বরনাশক ওষুধ খেলে এগুলো কমে যায়। অর্থাৎ এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক নয়। 

তবে অতি নগণ্য ক্ষেত্রে কারো কারো শরীরে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া বেশি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত টিকা-পরবর্তী এক ফার্মাকোভিজিল্যান্স জরিপের ফলাফল এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তারা গত ১৪-২৩ ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালে ১৮, ৯৩, ৩৬০ জন টিকা গ্রহীতার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছেন যে, মারাত্মক অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার এই হার প্রতি ১ লাখ জনে মাত্র প্রায় এক জন। সিডিসি তার এই জরিপের ফলাফলে আরও জানিয়েছে যে, ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সামান্য কিংবা মারাত্মক উভয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই টিকা প্রয়োগের আধা ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায় এবং তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশ মানুষের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা রয়েছে। যাদের শরীরে এই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তাদের ৯০ শতাংশ নারী।

আরও পড়ুন: শিকাগোতে হামলা, বন্দুকধারীসহ নিহত ৪

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত টিকা পেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু যতদিন এরকম না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন আমাদেরকে করোনার বিরুদ্ধে নীরব দর্শক হয়ে না থেকে সেগুলোকেই ব্যবহার করতে হবে। আমাদের বাল্যকালে কলেরার টিকার কথা আমাদের সমবয়সীদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে। সেই টিকা নেওয়ার পর ইনজেকশনের জায়গা ভীষণ ফুলে যেত, প্রচণ্ড জ্বর আসত, খুবই ব্যথা হতো। সে কষ্ট এমনই তীব্র ছিল যে, আমরা কয়েক দিন স্কুলে পর্যন্ত যেতে পারতাম না। কিন্তু তার পরেও কলেরার ভয়ে সেই বিভীষিকাময় টিকাও আমরা নিয়েছি। কিন্তু আজ কলেরার টিকা সে রকম ভয়ানক নেই। তা সময়ের, অভিজ্ঞতার ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে। এখন কলেরার টিকায় মৃদু ব্যথা হয় মাত্র। সব টিকার বেলায়ই নিয়মটা একই। করোনার টিকাও মাত্র বেরিয়েছে। এখন তার যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তা অন্যান্য টিকার তুলনায় কম। যত সময় যাবে ততই এটি আরও উন্নত হবে।

মানুষ এখনকার দিনে সদ্যোজাত শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কমবেশি ১৪টি টিকা গ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী গত ২২ বছরে সারা পৃথিবীতে ৩০ লাখ মানুষকে বিভিন্ন রকম টিকা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮০ জনের ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার পর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, কিন্তু এতে কেউ মারা যাননি। অর্থাৎ গত ২২ বছরে শুধু টিকা নেওয়ার কারণে ১৮০ জন অসুস্থ হলেও কেউ বিভিন্ন রকম টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এটাই তো সঠিক সিদ্ধান্ত। ওষুধবিজ্ঞানে ‘রিস্ক-বেনিফিট রেশিও’ বলে যে নিয়মটি আছে তা হলো সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই কোনও ওষুধ ব্যবহারের আগে ঝুঁকির চাইতে লাভ বেশি কি না—তা হিসাব করতে হয়। করোনার টিকার বেলাতেও সবাইকে এই লাভক্ষতির বিষয়টি মাথায় রেখেই টিকা নিতে হবে। অন্যদিকে করোনার টিকা নিলে এই টিকা থেকে করোনা হওয়ার কারণ নেই। যদি করোনার জীবাণু টিকা নেওয়ার আগেই শরীরে ঢুকে থাকে তাহলে এই টিকা কাজ নাও করতে পারে।

আরও পড়ুন: হামলার পেছনে কারা?

টিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই এ কারণে যে, এসব কোনও টিকাতেই জীবন্ত কোনও ভাইরাস নেই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এস্ট্রাজেনেকার যৌথ উদ্যোগের টিকা তৈরিতে সর্দির ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে ব্যবহার করা হয়েছে। সদ্য আবিষ্কৃত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং বেথ ইসরায়েল মেডিক্যাল সেন্টারের যৌথ গবেষণার টিকাও একইভাবে ভাইরাসকে মেরে জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা। এই টিকাটি এখনো মিডিয়াতে আসেনি। এটি এফডিএ-এর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সবকিছু অর্থাৎ কার্যকারিতা ও নিরাপত্তাবিষয়ক পর্যালোচনা ঠিক থাকলে হয়তো এ মাসেই অনুমোদন পেয়ে যাবে। 

ফাইজার ও বায়োএনটেকের যৌথ টিকা এবং মডার্নার টিকা মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি যেখানে জেনেটিক কোডের অতি সামান্য অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দিয়ে ভাইরাসের গায়ের প্রোটিনের মতো কিছু প্রোটিন শরীরের কোষ থেকে তৈরি করা হয় এবং কাজ শেষে এই কোড আপনা-আপনিই বিনষ্ট হয়ে যায়। এই করোনাসদৃশ প্রোটিনগুলোর কারণে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে করোনা প্রতিরোধ করে। চীনের সিনোভ্যাক, রাশিয়ার গামালিয়া ও ভারতের ভারত বায়োটেকের টিকাগুলোও অক্সফোর্ডের মতোই, যেখানে কোনও জীবন্ত বা সুপ্ত ভাইরাস নেই। তাই টিকা থেকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এমনকি এগুলো শরীরের ডিএনএরও কোনও পরিবর্তন করতে পারে না।

কদিন আগে একটা দেশের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, করোনার টিকা নিলে মানুষ নাকি কুমির হয়ে যাবে। এরকম আজগুবি কথা শুনলে ক্রোধের পাশাপাশি করুণাও হয় যে, এসব লোকজন প্রেসিডেন্ট হয় কি করে। করোনা মহামারিতে সারা পৃথিবীর মানুষই দিশেহারা। চোখের সামনে অসহায় মৃত্যু দেখে মানুষ আতঙ্কিত। এ সময়ে মানুষকে সঠিক পরামর্শটাই দিতে হবে। মিথ্যা আশ্বাস আর বিশ্বাস নিয়ে নয়, সত্যকে তুলে ধরে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা এবং চিকিত্সাবিষয়ক অর্জনগুলোকে ব্যবহার করে সম্মিলিতভাবে আমাদের এই মহাদুর্যোগকে প্রতিরোধ করতে হবে। এখানে মনগড়া, আজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা মানুষকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেবে।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন