জমিলা বেগম, বুলবুলী বেগম ও সুনেত্রা রানী কাজ করেন গাইবান্ধার এবিসি মফ্ট ভাটায়। বছরের ছয় মাসই তাদের কাটে এই ইটভাটার ধুলার মধ্যে। দৈনিক মাত্র ৪০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। সেই টাকা দিয়েই চলে তাদের জীবন ও আনন্দ। এমন একটি ছবি ফ্রেমবন্দী করে বর্ষসেরা পুরস্কার বিজয়ী হয়েছেন ফোকাস বাংলার আলোকচিত্রী কুদ্দুস আলম।
আরেকটি ছবিতে দেখা গেল ঢাকা নিউ মার্কেটে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিভিয়ে আনলেও তীব্র গরম এবং ধোঁয়ায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় স্বস্তির আশায় পানির ট্যাংকের পাইপ থেকে চোখে মুখে স্বস্তির জলে নিজেকে জুড়িয়ে নিচ্ছেন এমন একটি ছবি ফ্রেমবন্দী করে বিশেষ সম্মাননা পেলেন ইত্তেফাকের আলোকচিত্রি আব্দুল গনি। এমনই অনেকের ফ্রেমে ধরা দিল বিস্ময় ও আনন্দ বেদনার গল্প।
শুক্রবার (৫ জুলাই) সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সম্মুখ সারিতে কর্মরত আলোকচিত্র সাংবাদিকদের অর্জনকে উদযাপন এবং সম্মান জানাতে দৃক পিকচার লাইব্রেরি কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশ প্রেস ফটো প্রদর্শনী ২০২৪ উদ্বোধনীতে এ পুরস্কার পেলেন তারা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, শিল্পী ও আন্দোলনকর্মী আলোকচিত্র সাংবাদিক মনিরুল আলম, ফটোব্যাংক গ্যালারির শোয়েব ফারুকী। স্বাগত বক্তব্য দেন দৃক পিকচার লাইব্রেরীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন দৃকের জেনারেল ম্যানেজার ও প্রদর্শনীর কিউরেটর এএসএম রেজাউর রহমান।
এবারের প্রদর্শনীতে ২০২২ সাল থেকে দৃকের ধারাবাহিক আয়োজন বাংলাদেশ প্রেস ফটো কনটেস্ট (বিপিপিসি) এর ৩য় সংস্করণে নির্বাচিত ৩০টি আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। এবছর ১৬ এপ্রিল ছবি আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতাটি উন্মুক্ত করা হয়। এতে আলোকচিত্র সাংবাদিকরা ২০২৩ সালে তোলা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রায় একহাজারের বেশি ছবি জমা দেন।
তাসমিমা হোসেন তার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, আলোকচিত্র সাংবাদিকদের কাজ অনেক কঠিন। তাদের সকল কিছু আলাদা চোখ দিয়ে দেখতে হয় কিন্তু সেই দেখার চোখের আজ অনেক অভাব। তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করারটাও সমানভাবে জরুরি।
শহিদুল আলম বলেন, দুনিয়ার কোনো প্রেস ফটো প্রতিযোগিতায় আমার জানা মতে গণমুখী সাংবাদিকতার ক্যাটাগরি নেই। মিডিয়ার মালিকানাসহ নানা কারণে তারকা বা প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ দলীয় প্রচারেই মিডিয়ার কাজ সীমাবদ্ধ থাকে। আজকের প্রদর্শিত ছবিগুলোর আলোকচিত্রীরা নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকেই এই কাজগুলো করেছে। তাদের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে বাংলাদেশের আলোকচিত্র আজ অনেক দূর পৌঁছে গিয়েছে।
অমল আকাশ বলেন, আমি নিজে ছবি আঁকার এবং গানের মানুষ, কিন্তু দৃক আমাকে এই প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে সুযোগ দিয়ে দেখিয়েছে যে অন্য মাধ্যমের মানুষ এবং শিল্পীদেরও এই বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবার সুযোগ আছে।
মনিরুল আলম বলেন, আলোকচিত্র সাংবাদিকদের প্রথাগত ছবির বাইরে, সাধারণ অনুষ্ঠানের ছবি ছাড়া অন্য ছবি তোলার অভ্যাস করতে হবে, যে সকল ছবি অনন্য এবং আলাদা সেগুলোই মানুষের মনে ধরে, প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। আর যারা এবছর পুরস্কার পায়নি তাদের চেষ্টা করে যেতে হবে।
শোয়েব ফারুকী বলেন, সাংবাদিকদের চোখ খোলা রাখতে হবে নতুন ধরনের ছবির জন্য। নতুন ছবি সহজেই যেকোন মানুষের চোখে পরে এবং পুরস্কার জেতার দৌড়ে এগিয়ে থাকে।
এবারে বর্ষসেরা আলোকচিত্র ২০২৩ বিজয়ী ফোকাস বাংলার কুদ্দুস আলম এবং তিনি পুরস্কার পেয়েছেন ১,০০,০০০ টাকা। একইসাথে তিনটি বিভাগে পুরস্কার জিতেছেন আরও ছয়জন আলোকচিত্রী। বিভাগ বিজয়ীরা হচ্ছেন-শিল্প, সংস্কৃতি এবং ক্রীড়ায় কাজী গোলাম কুদ্দুস হেলাল, এফআইএপি এবং বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন নিউজবাংলা২৪.কম এর পিয়াস বিশ্বাস।
রাজনীতি বিভাগে দৈনিক প্রথম আলোর মো. সাজিদ হোসাইন এবং বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নায়েম আলী। জনমুখী সাংবাদিকতায় পুরস্কার পেয়েছেন দৈনিক বাংলা’র সৈয়দ মাহমুদুর রহমান এবং বিশেষ সম্মাননা দৈনিক ইত্তেফাকের আবদুল গনি।
প্রতিটি বিভাগ থেকে একজন বিজয়ী ও একজন বিশেষ সম্মাননা পুরষ্কার বিজয়ী পেয়েছেন যথাক্রমে ৫০,০০০ টাকা ও ১০,০০০ টাকা। পাশাপাশি তারা প্রত্যেকে পেয়েছেন সম্মাননা স্মারক এবং সনদ।
এ ছাড়া দৃক ২০২৩ সাল থেকে আলোকচিত্র সাংবাদিকতায় প্রান্তিক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী গ্র্যান্ট’ প্রবর্তন করেছে। এ বছর এই গ্র্যান্টটি জিতেছেন আদিবাসী আলোকচিত্রী ডেনিম চাকমা, যার মূল্যমান ৫০,০০০ টাকা। গ্রান্টের সার্টিফিকেট গ্রহণকালে তিনি বলেন, কাজ করতে গিয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়ে ছবি তোলাটা একটা যুদ্ধ মনে হয়। সবসময় একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি বরাজ করছে। কখন কি হয় বলা যায় না।
অনুষ্ঠানে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন আলোকচিত্রী এবং লেখক জান্নাতুল মাওয়া। তিনি বলেন, বছর তিনেক আগে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছবির প্রতিযোগিতায় আমি বিচারক থাকাকালীন একটা ছবির পক্ষে কথা বলি। তখনো জানতাম না সেটা ডেনিমের কাজ। আজ ওকে এখানে এই গ্র্যান্ট জিতে নিতে দেখে খুব ভালো লাগছে। একইসাথে এবারের প্রদর্শনীতে ২০২৩ সালের প্রথম অনুদান বিজয়ী পদ্মিনী চাকমার কিছু বাছাইকৃত ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে।
প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত, প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।